দাবি একটাই ‘পদত্যাগ’

আহমেদ হৃদয় প্রকাশিত: মে ৬, ২০২৩, ১২:৫২ এএম
  • নির্ভার সালাউদ্দিন, ভাবখানা এমন যেন কিছুই জানেন না তিনি
  • বাংলাদেশের প্রায় সব সাংবাদিক সংগঠনও সালাউদ্দিনের পদত্যাগ দাবি করেছে
  • তার সদস্যপদ বাতিল করেছে ‘বিএসপিএ’

সালাউদ্দিন নিজেও জানেন সোহাগ সামনে এলে তাদেরও অনেক অনিয়মের তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে 
—গোলাম সরোয়ার টিপু, সাবেক ফুটবলার ও কোচ

দেশের ফুটবলের জন্য সালাউদ্দিন অশনিসংকেত। যতটুকু সম্মান আছে, সেই সম্মান নিয়ে তার এখনই পদত্যাগ করা উচিত
—আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সাবেক তারকা ফুটবলার

১৮ কোটি মানুষই ফুটবল ফেডারেশনের দুর্নীতির বিষয়ে জানে। এখন আন্তর্জাতিকভাবেও সবাই জানে ফুটবলেও এমন দুর্নীতি হয় বাংলাদেশে —ব্যারিস্টার সুমন

এত কিছু হয়ে গেল, এত অনিয়ম ধরা পড়ল— অথচ তার ভাবখানা এমন যেন তিনি কিছুই জানেন না। বাংলাদেশ ফুবটল ফেডারেশনের সভাপতি তিনি, অথচ তার যেন কোনো দায়ই নেই! দিব্যি তিনি আছেন তার মতো করেই। তারই ফেডারেশনে এত অনিয়ম হচ্ছে অথচ তার যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই। সর্বশেষ গত ২ মে বাফুফের এক সভায় সাংবাদিকদের নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন কাজী সালাউদ্দিন।  ‘সাংবাদিকদের বাফুফে ভবনে ঢুকতে হলে তাদের ও তাদের বাপের জুতা পরা ছবি দিতে হবে। এ সময় কাজী মো. সালাহউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে সাংবাদিকদের অনেকটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কাজী নাবিল আহমেদকেও বলতে শোন যায়— ‘আমার রিকুয়েস্ট হচ্ছে অন্য। কে আন্ডারওয়্যার পরে বড় হয়েছে আর কে হয়নি সেটিও দেখতে হবে।’ তাদের এমন মন্তব্যে ফুটবলপাড়া থেকে শুরু করে সাংবাদিক সমাজেও চলছে তুমুল সমালোচনা। এমন মন্তব্যের পর অবশ্য তারা দুঃখ প্রকাশও করেছেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। চারিদিকে এখন শুধু একটিই দাবি, সালাউদ্দিনের পদত্যাগ। দেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলোও তার পদত্যাগ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বিএসপিএ থেকে তার সদস্য পদও বাতিল করা হয়েছে। 

এদিকে বাংলাদেশ ফুটবলের উন্নয়ন তো দূরে থাক দিন দিন অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে দেশের ফুটবল। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ পরিবর্তন করেছেন মোট ২৩ বার। কয়েক দিন পরপর কোচ

পরিবর্তন করলে সেই দলটি উন্নতি করবে কিভাবে এটিও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, ১৫ বছরে যে ২৩ কোচ পরিবর্তন করেছেন সালাউদ্দিন, তার মধ্যে ১৬ জন বিদেশি কোচ অপমানিত হয়ে বাফুফে ছেড়েছেন। কখনো ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছেন কোচদের ওপর, আবার কখনো কখনো মিডিয়ার ওপরেও দোষ চাপিয়েছেন বাফুফে সভাপতি। মন্ত্রণালয়ের ওপর দোষ চাপাতেও কর্ণপাত করেননি তিনি। শুধু কী তাই! ফিফা কর্তৃক বাফুফের সাবেক সেক্রেটারি আবু নাঈম সোহাগের দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা এবং বাফুফের অনিয়মে দেশের ইমেজ যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি দেশের ফুটবলের বড় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ফিফার তদন্তও যেন মানতে নারাজ সালাউদ্দিন। ফিফার দেখিয়ে দেয়া বড় সড় অনিয়মে ভীষণ ক্ষুব্ধ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। 

সম্প্রতি ফেডারেশনের হিসাব শাখার দায়িত্বশীলদের ডেকেছিলেন তিনি। কেন এত বড় অনিয়ম তাদের চোখ এড়িয়ে গেল সে বিষয়ে জানতে চান। এরই সূত্রধরে চাকরি হারাতে যাচ্ছেন বাফুফের হিসাব শাখার দায়িত্বশীলরা। জানা গেছে, বাফুফের এক সহসভাপতি ফেডারেশনের অ্যাকাউন্টসের লোকদের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। হয়তো বাফুফের আরো কিছু বেতনভুক নির্বাহীও চাকরি হারাতে পারেন। এ বিষয়ে বাফুফে সভাপতি বলেছেন, ‘আমি ফিফা ৫১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পড়ে দেখেছি। কিভাবে এত বড় অনিয়ম হলো তাই আমি জানতে চেয়েছি বাফুফের হিসাব শাখার কাছে। তারা বলেছে তারা সব কিছুই দেখেছে। কিন্তু আমার মনে হয় তারা সিরিয়াস ছিল না এই কাজে। একেবারে রিলাক্স মুডে কাজ করেছে। তারা বাফুফে থেকে বেতন নিয়েছে কিন্তু কাজ ঠিকমতো করেনি। এ জন্যই আজ দেশের ফুটবলের ইমেজ নষ্ট হলো। এর পরই উল্লেখ করেন, কিছু লোককে তো বরখাস্ত হতেই হবে।’

২০১৬ সাল থেকে বাফুফের বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ফিফার চোখে পড়ে। এরপরই শুরু হয় তদন্ত। তবে বিষয়গুলো এত দিনেও বাফুফে সভাপতির নজরে কেন আসেনি। কাজী সালাউদ্দিনের জবাব, ‘এত কিছুতে তো আমার নজর দেয়ার সময় নেই। সে কাজও নয় আমার। প্রত্যেকটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটি আছে। আমি বেশি নজর দিয়েছি জাতীয় দল নিয়ে।’ ফিফার তদন্ত প্রতিবেদনে এক জায়গায় বলা হয়েছে, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ও জাতীয় কোচদের বেতন দুবার দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাফুফে সভাপতির জবাব, ‘না না কোনোভাবেই দুবার বেতন দেয়া হয়নি। প্রথমে তাদের নগদ টাকায় বেতন দেয়া হয়েছে। এরপর ডলারের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়েছে। ডলার দিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এক বেতন দুবার দেয়া হয়নি।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার গোলাম সরওয়ার টিপু আমার সংবাদকে বলেন, ‘কাজী সালাউদ্দিন ফুটবলের উন্নতির জন্য এসেছে এই কথাটি আমি বিশ্বাস করি না। অনতিবিলম্বে সব ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ফেডারেশন থেকে তার পদত্যাগ করা উচিত। ২০০৮ সালে যখন কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচন করেন, তখন আমি বিরোধিতা করেছিলাম। সালাউদ্দিন ভালো ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু ভালো ফুটবলার বলে তিনি সংগঠক নয়। গত ১৫ বছরে ফুটবলের জন্য তারা কি করেছেন? কিছুই করেনি। ফুটবলের কোনো উন্নতিই তারা করতে পারেনি। সিলেটে ক্যাম্প শুরু করল কিন্তু তিন মাসও সেই চালাতে পারল না। মফস্বলে কোনো খেলা নেই। বাফুফের কোনো ইন্টারেস্টই নেই ফুটবলের উন্নতি করার। গত ১৫ বছরে ফুটবলের জন্য তারা কোনো কাজ করেনি।’ 

মেয়েদের অলিম্পিক খেলতে মিয়ানমার না যাওয়ার ব্যাপারে গোলাম সরোয়ার টিপু বলেন, ‘আসলে মেয়েদের মায়ানমার পাঠানোর কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাদের। ওইখানে বড় বড় দল খেলবে; যদি তাদের কাছে হেরে যায় তাহলে তারা কী জবাব দেবে, এটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে এটি আমার ব্যক্তিগত ধারণা মাত্র।’ সোহাগ ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘আসলে এটা একটা চরম অন্যায় কিন্তু তাদের কাছে এটি কোনো বিষয়ই না। ফিফা থেকে সোহাগকে নিষিদ্ধ করা হলো দুই বছরের জন্য। কিন্তু বাফুফে থেকে তাকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে দিলো। কারণ সালাউদ্দিন নিজেও চান না যে সোহাগ বাফুফেতে আসুক কিংবা এখানে সে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হোক। কারণ সালাউদ্দিন জানেন, সোহাগ সামনে এলে তাদেরও অনেক অনিয়মের তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। যে কারণে সালাউদ্দিন চান না সোহাগ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হোক।’ তিনি আরও বলেন, এখানে তাদের অন্য কোনো বেনিফিট আছে। তা না হলে এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি কেন পদত্যাগ করছে না। মানুষের তো ন্যূনতম লজ্জা থাকে। তার কী কোনো লজ্জা নেই!’ সালাউদ্দিনের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে আর চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। সব ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে সালাউদ্দিনের পদত্যাগ করা উচিত। মানুষ এখন তাকে চায় না। দেশের কেউই এখন তাকে বাফুফেতে চায় না।’ ফুটবলের উন্নতি সম্পর্কে গোলাম সরোয়ার টিপু বলেন, ‘এ অবস্থায় আর দেশের ফুটবলের উন্নতি সম্ভব নয়। যদি বাংলাদেশের ফুটবলকে সামনে এগিয়ে নিতে হয় তাহলে নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দিয়ে ফেডারেশন পরিচালনা করতে হবে। এখানে আর আলোচনা করার কিছু নেই। এখন আর আলোচনা দিয়ে কিছু হবে না।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলকে কতটা ভালোবাসে তা আমরা সবাই জানি। ফুটবল বিশ্বকাপে তার প্রমাণও মেলে। ভিনদেশি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলকে নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের উন্মাদনা সারা বিশ্ব জানে। এ দেশে ফুটবল আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল, এখনো আছে।’ তিনি বলেন, ‘সালাউদ্দিনের কমিটি গত ১৫ বছরে কোনো কাজ করেনি। তাদের কমিটি সম্পূর্ণভাবে বিফল। তাদের খামখেয়ালি আজ দেশের ফুটবলকে এত নিচে নামিয়ে এনেছে। এই যে ফিফা থেকে এত টাকা আসে কিন্তু এই টাকা কোথায় যায় তা দেশের কেউ জানে না। অথচ ফুটবলের এতটুকুও উন্নতি হয়নি।’ 

বাফুফের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু বলেন, ‘বাফুফের দুর্নীতি-অনিয়ম আজ নতুন নয়। এটি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। সাংবাদিকরাও এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই বলেছিল কিন্তু সালাউদ্দিন কারো কথায় কোনো কর্ণপাত করেননি। এখনো তিনি কারো কথায় কোনো কর্ণপাত করেন না। তবে ফিফা তাদের দুর্নীতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করল। তবুও কী সালাউদ্দিন এতটুকু দায় স্বীকার করেছেন? তিনি সাংবাদিকদের তো ছাড় দেনই না, আজ সাংবাদিকদের মা-বাবাকেও তিনি ছাড়লেন না। তাদের মা-বাবাকে নিয়েও তিনি বাজে মন্তব্য করলেন। এক কথায় সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের সহ্য করতে পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ফুটবলের জন্য সালাউদ্দিন অশনি সংকেত। বাংলাদেশের ফুটবলকে বাঁচাতে হলে অতিসত্বর বাফুফে থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। তার যতটুকু সম্মান আছে সেই সম্মান নিয়ে তার এখন পদত্যাগ করা উচিত। তা না হলে দেশের ফুটবলকে বাঁচানো সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘সালাউদ্দিন একজন ভালো ফুটবলার ছিলেন। সেই হিসেবে মানুষ তাকে সম্মান করত কিন্তু সেই সম্মান তিনি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছেন। মানুষ তাকে এখন আর চায় না।’

এদিকে বাফুফের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুদকে আবেদন করেছেন ব্যারিস্টার সুমন। এ সময় গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘১৮ কোটি মানুষ যদি বাংলাদেশে থাকে, তাহলে ১৮ কোটিই ফুটবল ফেডারেশনের এসব দুর্নীতির বিষয়ে জানে। এখন আন্তর্জাতিকভাবেও সবাই জানে যে, ফুটবলেও এমন দুর্নীতি হয় বাংলাদেশে। সোহাগ ইস্যুতে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা কাজ শুরুর আগেই দুজন পদত্যাগ করেছেন। তাহলে আপনারা বুঝেন কী তদন্ত হবে। ফিফার তদন্তে সমপ্রতি দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ। জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলারদের পাশাপাশি বাফুফের অনেক কর্মকর্তাই মনে করেন, সভাপতি সালাউদ্দিনের ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর দুর্নীতি করে গেছেন সোহাগ। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে মিডিয়ার প্রতিও ক্ষুব্ধ কাজী সালাউদ্দিন। বরাবরই বিতর্কিত মন্তব্য করা সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের নিয়েও যাচ্ছে তাই বলে ফেলেছেন, যা সভ্যতা-ভব্যতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জার্নালিস্টরা এখানে ঢুকতে গেলে তাদের আমার এখানে ফটো দিতে হবে তাদের মা-বাবার। আরেকটি কন্ডিশন হলো, তার বাপের ফটো পাঠাবে জুতা পরা। ঠিক আছে, এটি হতে হবে ম্যান্ডেটরি।’ ব্যারিস্টার সুমন আরো বলেন, সাংবাদিকদের বাবা-মাকে নিয়ে যা বলেছেন সালাউদ্দিন, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে এটিই বলব যে, পুলিশ যেমন মাদক শনাক্তে ডোপটেস্টের ব্যবহার করে, তেমন ফুটবল ফেডারেশনে ডোপটেস্টের ব্যবস্থা করে সালাউদ্দিনদের ডোপটেস্ট করানো উচিত।’