পণ্য আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে বড় পার্থক্যের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। এটি বৈদেশিক বাণিজ্যে রীতিমতো উদ্বেগ তৈরি করছে। একই সাথে ডলার মার্কেটে অশান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিগত বকেয়ার চাপে আমদানিতে লাগাম টেনেও ঘাটতি কমাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আসছে না কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্সও। ফলস্বরূপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিপুল বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৬১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ধরে) এর পরিমাণ এক লাখ ৫৭ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশ পাঁচ হাজার ৩৯৩ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ছয় হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের (প্রথম ৯ মাস) চেয়ে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম আমদানি হয়েছে।
কিন্তু আমদানির বকেয়া দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে তাই ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৯ মাসে গড় আমদানি ব্যয় ছয় বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে গড়ে রপ্তানি আয় এসেছে মাত্র ৪৩৬ কোটি ডলার। অর্থবছরের একই সময়ে দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৯৩২ কোটি ডলারের পণ্য। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে তিন হাজার ৬৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রার সংকট কাটাতে নানা শর্ত দেয়া হয়েছে আমদানিতে। এতে করে এলসির হার কমলেও আমদানি দায় পরিশোধ কমেনি। এখনো রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানিতে এখনো বেশি খরচ করতে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ও দিন দিন কমছে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড় আশানুরূপ নয়। একই সময়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমছে বিদেশি বিনিয়োগ। যার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতির পাশাপাশি সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনেরও বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, মার্চ শেষে অর্থবছরের ৯ মাসে সেবা খাত থেকে দেশের আয় হয়েছে ৬৫০ কোটি ডলার। একই সময়ে সেবা খাতে ব্যয় হয়েছে ৯৪০ কোটি ডলার। এ সময়ে সেবা খাতে ২৮৯ কোটি ডলার ঘাটতি দাঁড়িয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৭৯ কোটি ডলার। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা মানে নিয়মিত লেনদেনে কোনো ঋণ করতে হয় না দেশকে। আর ঘাটতি থাকলে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সে হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের জন্য চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। তবে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স এখন ঋণাত্মক। তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৩৬৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৪৩৪ কোটি ডলার। সে হিসাবে ঘাটতি কিছুটা কমেছে। আলোচিত সময়ে দেশ সামগ্রিক লেনদেনেও বড় ঘাটতিতে পড়েছে। মার্চ শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১৬ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে (ঋণাত্মক) ছিল ৩০৯ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এক হাজার ৬০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৫২৯ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। কিন্তু গত ৯ মাসে যত সংখ্যক কর্মী প্রবাসে গেছে; সে তুলনায় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চলতি অর্থবছরের এ সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছে। আলোচিত ৯ মাসে এফডিআই এসেছে ৩৭৮ কোটি ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ছিল ৩৫৩ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৭ শতাংশ। তবে আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কমে গেছে। মার্চ শেষে নিট এফডিআই দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি ডলারে। গত অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৬৩ কোটি ডলার। বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। অর্থবছরে প্রথম ৯ মা?সে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে চার কোটি এক লাখ ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১১ কোটি ডলার।