বিপর্যস্ত গ্রামীণ জনপদ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: মে ১২, ২০২৩, ১১:১৭ পিএম

গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানীতে বড় প্রভাব না পড়লেও চরম ভোগান্তিতে মফস্বলে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা। শীত শেষে গত মাস থেকে ফের লোডশেডিং দেখা দেয়। রামপাল, পায়রা ও আদানির বিদ্যুতে লোডশেডিং অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। পরে কয়লার সংকট দেখা দিলে বন্ধ হতে শুরু করে উৎপাদন কার্যক্রম। বাড়তে থাকে লোডশেডিং। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ের ফলে জনজীবন চরম বিপর্যয়ের মুখে। হাঁসফাঁস করছে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন সাড়ে তিন কোটি মানুষ। সেই সঙ্গে চাহিদামতো বিদ্যুৎ না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদনও।

তীব্র গরমে মানুষের যখন বেহাল দশা তখন বাংলাদেশজুড়ে বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাকাল হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন চাহিদার বিপরীতে প্রায় এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দিনে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে বলে খবর আসছে। গরমের মধ্যে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তিন কারণে লোডশেডিং বেড়েছে। চরম গরমে এসির লোড মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। জ্বালানির অভাবে ও যন্ত্রপাতি সংরক্ষণে বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায়। এরপর রংপুর, খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা ও সিলেটে। তবে বরিশাল অঞ্চলে লোডশেডিং নেই বললেই চলে। রংপুরের দিন-রাত মিলিয়ে তাদের এলাকায় ছয়-আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। বিশেষ করে রাতে বিদ্যুৎ চলে যায়। এভাবেই দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতেও দিনে দুই-একবার লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেছেন, ঢাকায় চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। তাই লোডশেডিং তেমন নেই, যা হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) একজন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় তারা লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুত্যায়ন বোর্ডের। ৮২টি সমিতির মধ্যে ৬৩টির অবস্থা নাজুক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী বলেন, তারা দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। ফলে কোথাও কোথাও অর্ধেক সময়ও বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হয় না। বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, গরমের কারণে এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়েছে। এতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। তাই কিছু এলাকায় সাময়িক ঘাটতি হচ্ছে। 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক কর্মকর্তা জানান, দুই সপ্তাহ ধরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ। সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় তিন হাজার ৪৮৬ মেগাওয়াট উপাদন করা যায়নি। পাশাপাশি জ্বালানি সংকট রয়েছে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে গত সোমবার তিন হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে। তিনি জানান, পিডিবির দিনে প্রয়োজন ১৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সোমবার পাওয়া গেছে ১১৩ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলাকে অনুরোধ করেছে পিডিবি। এদিকে সংকটে বন্ধ য়ার শংকায় দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা। কারণ ডলার সমস্যায় কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে প্রায় ১২শ মেগাওয়াট পাওয়া যায়। তাই এই কেন্দ্র বন্ধ হলে লোডশেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সমস্যার সমাধানে পায়রা কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। 

পাওয়ার সেলের হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ মে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। আর এর আগের দিন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫২ মেগাওয়াট। সে হিসেবে আজই দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৪৮ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগে যে পরিমাণ লোডশেডিং হয়েছে তার মধ্যে গত ৭ ও ৮ মে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ছিল। আর সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে ময়মনসিংহ জেলায়। এই বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ৮ মে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল ও রংপুরে মোট এক হাজার ৩৫৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। পাওয়ার সেলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। বাংলাদেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা চার কোটি ৪৮ লাখ। এই গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। মে মাসের প্রথম আট দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল গত ৭ মে। এদিন মোট ১৪ হাজার ৩৩১ মোগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল। এ ছাড়া বাকি দিনগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। একই চিত্র দেখা গেছে এপ্রিল মাসজুড়েও। এ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ হাজার থেকে শুরু করে ১৪ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

তবে এ মাসের ১৯ তারিখে দেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন। এর আগের দিনও ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম কেন্দ্র রয়েছে ১৫৪টি। যার মধ্যে বেশির ভাগই ভাড়ায় চালিত ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলেও সেখানেও কাঁচামাল সরবরাহ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ডলার আর কয়লা সংকটের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একবার রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত ২৩ এপ্রিল থেকে কয়লা সংকটের কারণে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রেরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দৈনিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘সরকারের আশা ছিল পায়রা ও রামপালের মতো বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এই গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সংকট মেটাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি দেখা যায়নি। এদিকে এর আগে বোরোর সেচ মৌসুম এবং পবিত্র রমজান মাসকে গুরুত্ব দিয়ে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল ঈদের আগে। এতেও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকার মানুষ কিছুটা লোডশেডিংয়ে ভুগেছে। এরপর ঈদের ছুটি স্বস্তি নিয়ে আসে। ছুটি শেষ, দুই দিন ধরে তাপমাত্রাও বাড়ছে; এর সঙ্গে ঢাকার বাইরে বাড়তে শুরু করেছে লোডশেডিং।’

বন্ধ রামপাল, শঙ্কায় পায়রা : ডলার সংকটে কয়লাভিত্তিক দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আবারও টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। সময়মতো ডলার না পাওয়ায় কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কয়লার অভাবে দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ হয়ে আছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। ডলার না পেলে উৎপাদন বন্ধ হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার। আর এতে বাড়তে পারে লোডশেডিং। এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সিলেট নগরের নয়া সড়ক এলাকার গৃহিণী পারভিন সুলতানা বলেন, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্যুৎ গিয়ে পৌনে ১২টার দিকে আসে। কিন্তু কিছু সময় পর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সিলেট বিভাগে পিডিবি গ্রাহকদের চাহিদা ছিল ২৩০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরবরাহ ছিল ১৩২ দশমিক ৩ মেগাওয়াট। পিডিবি সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ-ই-আরেফিন বলেন, চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ হলে লোডশেডিং করতে হয়। চট্টগ্রামে গতকাল তিনবার লোডশেডিংয়ের কথা বলেছিল পিডিবি। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে পাঁচবার। 

পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, দিনে ২০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট সরবরাহ কম পাচ্ছেন তারা। তাই সূচি মেনে লোডশেডিং করা যাচ্ছে না। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বর্তমান সময় বাংলাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়। একদিকে যেমন গ্রীষ্মকাল চলছে, তেমনি তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিক জ্বালানি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই সারা দেশে লোডশেডিং বাড়ছে বলে জানান তিনি। চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সংকট কাটিয়ে উঠে দেশে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। ফলে থাকবে না কোনো লোডশেডিং। আগামী তিন দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ঘাটতি রয়েছে তা কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। আর এর দুদিন পর থেকে কোনো ঘাটতি থাকবে না। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও জ্বালানি কেনার মতো ডলারের জোগান কম। তাই জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সরবরাহ ঘাটতি থাকলে তা সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া যায়। এতে এককেন্দ্রিক ভোগান্তিও কমে যেত।