রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ বাড়বে

নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৩, ০৭:৫৫ এএম

নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফের দুঃসংবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) তহবিল ঘাটতি দেখিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আবারও খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে তিন মাসে দুবার বরাদ্দ কমাল এ সংস্থাটি। এখন থেকে মাসিক বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলার করা হবে। আগামী ১ জুন থেকে এটি কার্যকরও হবে। এর আগেও মাসিক ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল বরাদ্দ।

এদিকে খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দেয়ার ফলে শরণার্থী শিবিরে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা হতাশ হয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মানবপাচারও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। আবার বর্তমান সময়ে মাদকের যে ভয়াবহতা চলছে, তাতেও জড়িয়ে পড়তে পারে রোহিঙ্গারা। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা না পাওয়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্থসামাজিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যা নিয়ে এমনিতেই বাংলাদেশ সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এরইমধ্যে খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা রোহিঙ্গা সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মত মানবাধিকারকর্মীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যে সংস্থাগুলো খাদ্যসহায়তা সরবরাহ করছে, তারা দ্বিতীয়বারের মতো  অনুদান কমিয়েছে; এটি উচিত নয়। যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়া হচ্ছে, সেখানে এক দশমিক দুই বিলিয়ন রোহিঙ্গার মৌলিক বিষয়ে হাত দেয়া অনৈতিক। অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাও চলছে। এর চাপ সারা বিশ্বেই চলছে। এজন্যও এটি হচ্ছে। তবে উন্নত বিশ্ব যুদ্ধ টিকিয়ে রাখছে, খাদ্যসহ সব ধরনের সহায়তাও বজায় রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরও খাদ্যসহায়তার জোগান রাখা উচিত ছিল। জানতে চাইলে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, খাদ্যসহায়তা কমানোর ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবশ্যই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। তবে তিনি বলছেন, সরাসরি সহিংসতায় না জড়ালেও তাদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হবে, সেটি থেকেই তারা অপরাধে জড়ানোর শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে প্রথম দফায় খাদ্যসহায়তা কমানোর সময় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছিল, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও মহামারির কারণে দাতাদের বাজেট কমে গেছে। এতে তহবিল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে মার্চ থেকে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ ১৭ শতাংশ কমিয়ে ১২ ডলার থেকে ১০ ডলার করা হয়। এবারও তহবিল ঘাটতির কারণেই কমানো হচ্ছে বরাদ্দ। এ বিষয়ে বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর অনো ভ্যান ম্যানেন স্থানীয় সাংবাদিকদের তখন বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক দাতারা যদি বাংলাদেশে আশ্রিত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের পরিবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে সেটা প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ হবে।’ 

বিভিন্ন পর্যায়ের রোহিঙ্গা নেতা বলছেন, এভাবে সহায়তা কমিয়ে দিলে আমাদের জীবনযাত্রার ওপর খুব বাজে প্রভাব পড়বে। কারণ, বাইরে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় এমনিতেই দুঃখ-কষ্টে জীবন চালাতে হয়। এখন তা আরও তীব্র হবে। এতে রোহিঙ্গাদের অভাব আরও বেড়ে যাবে। লোকজন অভাবে থাকলে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনাও বেশি থাকে। এ সিদ্ধান্তের ফলে শরণার্থী শিবিরে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ডব্লিউএফপির বিবৃতিতে সে সময় বলা হয়েছিল, নতুন করে অর্থসহায়তা না পেলে এই রেশন আগামী এপ্রিল মাস থেকে আরও কমানো হতে পারে। এই পরিস্থিতি এড়াতে দাতাদের কাছে সাড়ে ১২ কোটি ডলারের জরুরি তহবিলও চাওয়া হয়েছিল। তহবিল সংগ্রহ করতে না পারাতেই মূলত ডব্লিউএফপি ফের খাদ্যসহায়তা কমাতে বাধ্য হয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  
বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম দফায় খাদ্যসহায়তা কমানোর সময় বলেছিলেন, সহায়তা কমানোয় খুবই খারাপ প্রভাব পড়বে। খাদ্যের অভাব থাকলে রোহিঙ্গারা কাজের সুযোগ খুঁজতে ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। যারা অতিরিক্ত উপার্জন করতে পারবে না, তাদের পুষ্টির সমস্যা আরও বাড়বে। এখন ৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে পারে না। শিবিরে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো শিশুর সঠিক শারীরিক বিকাশ ও বৃদ্ধি হয় না। অন্তঃসত্ত্বা ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন— এমন নারীদের ৪০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। এটাও বাড়বে। 

টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা বলছেন, খাদ্যসহায়তা কমলে চুরি, ডাকাতি ও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়ে যাবে। অনেকেই এ ধরনের অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হবে। প্রথমে বরাদ্দ কমিয়ে ১২ ডলার থেকে ১০ ডলার করা হয়েছিল। তাতেও কোনোভাবে চলছিল। এখন আবার ১০ ডলার থেকেও কমিয়ে আট ডলার করা হয়েছে। এমনিতেই খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও জামাকাপড়সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হিমশিম খাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় বরাদ্দ আরও কমে গেলো। এতে রোহিঙ্গাদের পাচার কিংবা সমুদ্রপথে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কাতারে থাকায় তার বক্তব্য  নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে রোহিঙ্গা সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সভা শেষে বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সে লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও অংশ নেবে। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হত্যা ও নিপীড়নে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তার আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও কয়েক লাখ। কক্সবাজার ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে সব মিলিয়ে বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও অংশ নেবে —স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ অভিযানে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে রোহিঙ্গা সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সভায় অংশগ্রহণ শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রক্তপাত হচ্ছে। তাদের অপতৎপরতা বাড়ছে। সেজন্য সভায় এভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যেন ক্যাম্পের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সে লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা হবে। আরসা ও আরাকান আর্মির কেউ যেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে না ঢুকতে পারে, সেজন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সেজন্য প্রয়োজন মোতাবেক সেনাবাহিনীসহ যৌথ অভিযান হতে পারে।’ আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে ব্যাপক অভিযান চলবে। প্রয়োজনে যৌথ অভিযান চলবে। ক্যাম্প থেকে যেন কোনো রোহিঙ্গা বের হয়ে না আসতে পারেন, সেজন্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছি, ওয়াচ টাওয়ার হয়েছে, সেখানে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থাও আছে। সেগুলো আরও জোরদার করা হবে। যাতে তারা বাইরে না আসতে পারেন। যৌথ টহলসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় তৎপর থাকবে।’ 

আরএস