আমরা মাঠে থাকব যত রকমের পরিস্থিতি হোক
—শামা ওবায়েদ
চলছে চার পর্বে ঢাকাসহ ৭৩ সাংগঠনিক জেলায় বিএনপির পদযাত্রা। আন্দোলনের মিত্র জোট গণতন্ত্র মঞ্চও একই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। কর্মসূচি ঘিরে পটুয়াখালী, রাজবাড়ী, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও রংপুরে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। শতশত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার। পূর্বের ন্যায় কঠোর হার্ডলাইনে সরকার। এর মধ্যেও বিএনপি এবার আন্দোলন নিয়ে পিছু হটছে না। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছেন। গতকাল সহিংসতার আশঙ্কায় রাজশাহীতে পদযাত্রা ছিল নিষিদ্ধ, মাঠে অ্যাকশনে দেখা গেছে সোয়াতকে। ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা।
পুলিশের অভিযোগ, তাদের ওপর বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে, কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে আহত করা হয়েছে, গাড়িতে আগুন দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। এমন দৃশ্যপটে সারা দেশে অভিযান ও বিএনপি নেতাদের আটক করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপি নেতা রফিকুল আলম মজনুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদেও বিক্ষোভ-সমাবেশসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। শীর্ষ নেতারা বলছেন, সরকারের পদত্যাগ ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। আজকালের মধ্যে গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিএনপি অতীতে হামলা মামলার এমন পরিস্থিতিতে শীতল কর্মসূচি পালন করলেও এবার তারা পিছু হটবে না। দলের শীর্ষ নেতাদের আটক করা হলেও তৃণমূলের নেতাদের দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এমন বার্তা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ের নেতাদেরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া সমপ্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন এই সরকারকে সরাতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাও জানিয়েছেন, আন্দোলনে যারা অভিজ্ঞ তারা যেন মাঠে নামেন তাদের ভূমিকাও বিএনপি নেত্রী দেখতে চেয়েছেন। জুলাইয়ে মূল আন্দোলন টার্গেট করে এখন থেকেই যে কোনো পরিস্থিতিতে মাঠে থাকতে দলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত রয়েছে। দলের কর্মসূচিতে বাধা আটক এমন পরিস্থিতিতেও বিএনপি মাঠে থাকবে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ আমার সংবাদকে বলেন, আমরা মাঠে নামলে আওয়ামী লীগ ভীতু হবে, পরিস্থিতি এমনই হওয়ার কথা। আপনারা দেখেছেন আমাদের কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। এই সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব। যত রকমের পরিস্থিতি তৈরি হোক না কেন আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালিয়ে যাব এবং সব পরিস্থিতির বিপরীতে আমরা আরও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব। আমরা এবার আন্দোলনের মাঠ থেকে পিছু হটবো না।
ঢাকায় ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাসে আগুন : ঢাকায় বিএনপির পদযাত্রা থেকে পুলিশের দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে সংঘর্ষে জড়ান বিএনপির নেতাকর্মীরা। এসময় গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল ৪টার কিছু আগে পদযাত্রা নিয়ে নেতাকর্মীরা সিটি কলেজের সামনে পৌঁছালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। মিছিলে অংশ নেয়া কিছু নেতাকর্মী ওই স্থানে দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যেতে চাইলে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। তখন বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় তারা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পুলিশ বক্সও ভাঙচুর করা হয়। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম রবিসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটক করেন।
সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে দুপুরে ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। পদযাত্রাটি সাত মসজিদ রোড, রাইফেল স্কয়ার, ঢাকা সিটি কলেজ, সায়েন্সল্যাব, বাটা সিগন্যাল ও কাঁটাবন মসজিদের সামনে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সীমান্ত স্কয়ারের সামনে থেকে সিটি কলেজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে মারামারি শুরু হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। পুলিশি বাধার মুখে সিটি কলেজের সামনে গিয়ে বিকাল পৌনে চারটায় কর্মসূচি শেষ ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম।
রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আশরাফ হোসেন বলেন, আজকে (২৩ মে) বিএনপির একটি পদযাত্রা ছিল পূর্বনির্ধারিত। ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি আসার কথা ছিল সিটি কলেজ পর্যন্ত। খুব শান্তিপূর্ণভাবে তারা শুরু করেছিল। প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক ছিলেন পদযাত্রায়। কিন্তু পদযাত্রা শেষের সারি থেকে কিছু ছেলে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তারা ইট-পাটকেল মারে। ব্যানারের লাঠি দিয়ে পুলিশকে লাঠিপেটা করে। পুলিশও পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে তারা বিআরটিসি একটি বাসে আগুন দেয়, গ্লাস ভাঙে। সংঘর্ষ আমাদের বেশ কিছু পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি তারা না করলেও পারতো। এখন আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। এদিকে মহানগর উত্তর বিএনপির উদ্যোগে দুপুর আড়াইটায় গাবতলীর বাগবাড়ী আইএফআইসি ব্যাংকের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু হয়ে টেকনিক্যাল ও কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে শ্যামলী শিশু মেলার পাশ ও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে দিয়ে ৬০ ফিট রাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজশাহীতে পদযাত্রা ছিল নিষিদ্ধ, মাঠে অ্যাকশনে সোয়াত : রাজশাহীতে বিএনপির পদযাত্রার অনুমতি দেয়নি মেট্রোপলিটন পুলিশ। সিটি কর্পোরেশনের ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সোমবার রাতে আরএমপি থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে গতকাল নগরীতে সব ধরনের পদযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল আলম জানান। এদিকে সকাল থেকেই বিএনপি কার্যালয়সহ নগরীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে পুলিশ। বিভিন্ন সড়কে যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নগরী ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির পূর্বঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচির কারণে সকাল থেকে মহানগরীর মালোপাড়া এলাকায় বিএনপি কার্যালয়, ভূবনমোহন পার্ক, গণকপাড়া, সোনাদীঘি মোড় ও বাটার মোড় ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে পুলিশ। এ ছাড়া কল্পনার মোড় ও হোসনীগঞ্জ মোড়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। মাঠে নেমেছে পুলিশের বিশেষায়িত ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (সিআরটি)। প্রস্তুত রাখা হয়েছে পুলিশের এপিসি গাড়ি ও জলকামান। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল আলম বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের আগে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করলে মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য পুলিশ কমিশনার সব ধরনের পদযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ইশা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা ভূবনমোহন পার্ক থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে রেলগেট পর্যন্ত পদযাত্রা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবু সাঈদ চাঁদের ঘটনার কারণে পুলিশ আমাদের কর্মসূচি নিষিদ্ধ করেছে। আমরা এখন বসে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করব।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘সরকার আমাদের সব কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। আজ আমাদের পদযাত্রায় বাধা দিয়েছে। তারা আমাদের অফিসে তালা দিয়েছে। কাউকে প্রবেশও করতে দিচ্ছে না।’