ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজ

কাঙ্ক্ষিত মানোন্নয়ন হয়নি

মো. নাঈমুল হক প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২৩, ০৮:১৭ এএম

 

                                                                           ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজ

       সাত কলেজ                                                                                                           ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইয়ার পদ্ধতিতে পাঠদান                                                                                   সেমিস্টার পদ্ধতিতে চলছে অধিকাংশ বিভাগ 
অধিকাংশ বিভাগে শিক্ষার্থী দুই শতাধিক                                                       সব বিভাগে দুইশর কম শিক্ষার্থী
নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও শিক্ষক                                                                          পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও শিক্ষক আছেন
নিয়মিত ক্লাস পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা                                                                ৭৫ শতাংশের কম ক্লাস করলে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার

                                                                                                                             সুযোগ নেই
অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট দ্বিতীয় বিভাগ                                                  অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট প্রথম বিভাগ
 

ইতোমধ্যে সাত কলেজ অনেক উন্নতি করেছে
—ড. আক্তারুজ্জামান
উপাচার্য, ঢাবি

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পুনরায় সাত কলেজ ন্যস্ত করা উচিত
—ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

অধিভুক্তি বাদ দেয়াই সমাধান নয় 
—অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
সাবেক উপাচার্য, ঢাবি


দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত সাত কলেজের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। অথচ সাত কলেজের উদ্যোক্তারা এমনটি চাননি। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, মান উন্নত করার জন্যই কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যুক্ত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান হলেও সাত কলেজ চলে ইয়ার (বছর) পদ্ধতিতে। নিয়মিত ক্লাস পাচ্ছেন না সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজগুলোর অধিকাংশ বিষয়ে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। এসব শিক্ষার্থীর জন্য নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও শিক্ষক। সাত কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট দ্বিতীয় বিভাগেই বেশি থাকে। এসব সাত কলেজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। 

তবে ঢাবি উপাচার্য বলেন, ইতোমধ্যে সাত কলেজ অনেক উন্নতি করেছে। আগামীতে আরো ভালো করবে। শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন, সাত কলেজ একটি অর্থহীন উদ্যোগ। সাত কলেজকে পুনরায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেয়া উচিত। উদ্যোক্তারা মনে করেন, ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে পারলে সাত কলেজের মান আরো উন্নতি করা সম্ভব এবং তাই করা দরকার। জানা যায়, উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ২০১৭ সালে। প্রথম ধাপ হিসেবে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মান সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা রয়েছে।

অধিভুক্তকালীন ঢাবি উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কলেজগুলোর মান উন্নত করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যুক্ত করা হয়েছে। আমার সঙ্গে সাত কলেজের অনেক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকের কথা হয়। শুনেছি কলেজগুলো ইতোমধ্যে অনেক উন্নতি করেছে।’ কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাত কলেজ চলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অন্য কলেজগুলোর মতোই। প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ার (বছর) পদ্ধতি থেকে বের হতে পারেনি। অন্যদিকে ঢাবির অধিকাংশ বিভাগ সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট একাডেমিক ক্যালেন্ডারের আলোকে ঢাবির শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা দিচ্ছেন। রেজাল্টও পাচ্ছেন যথা সময়ে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলো দুর্লভ বিষয়। নিয়মিত ক্লাস পান না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। সব সময় সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। একাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকলেও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দু’মাস আগে পরীক্ষার তারিখ জানতে পারেন। অধিকাংশ বিভাগের রেজাল্ট পেতে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের  শিক্ষার্থী সংখ্যাও বেশি। 

২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাবি ও সাত কলেজের আসন সংখ্যার পার্থক্য : ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আসন সংখ্যা ২৬৫টি ও ঢাবির আসন সংখ্যা ১৫০টি। ঢাকা কলেজের গণিত বিভাগের আসন সংখ্যা ২১০টি, ঢাবির আসন সংখ্যা ১৩০টি। ঢাবির হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের আসন সংখ্যা ১৫০ টি। অথচ ঢাকা কলেজের আসন সংখ্যা দ্বিগুণ। ঢাবির তুলনায় সাত কলেজের শিক্ষকের সংখ্যাও কয়েকগুণ কম। ঢাবির ইংরেজি বিভাগের ৬০০ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ৩৪ জন। অন্যদিকে ঢাকা কলেজের এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র ১৩ জন শিক্ষক। ইডেন কলেজের অর্থনীতির শিক্ষার্থী এক হাজার ছয় শতাধিক। তাদের শিক্ষক রয়েছেন ২০ জন। কিন্তু ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের ৬০০ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন ৩৫ জন শিক্ষক। এভাবে প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থীর আদর্শ মানের ধারেকাছেও নেই সাত কলেজ। ফলে অধিক শিক্ষার্থীর পড়ানো ও খাতা দেখার চাপ থাকায় কাঙ্ক্ষিত মানে উত্তীর্ণ হতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ঢাবি অধিভুক্তির আগে আমাদের রেজাল্ট আরো ভালো ছিল। এখন আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট দ্বিতীয় বিভাগ। শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বিভাগ রেজাল্টের পেছনে ঢাবিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। সাত কলেজ ঢাবি শিক্ষক ও প্রশাসকদের কাছে অবহেলার নাম। এ ব্যাপারে ঢাকা কলেজের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী রেদোয়ানুল হক বলেন, ঢাবি অধিভুক্তির  আগে আমাদের রেজাল্ট ও পড়াশোনা ভালো চলছিল। হঠাৎ ঢাবি অধিভুক্তির পর থেকে প্রশাসনের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার শিকার হই। ঢাবি অধিভুক্তির পর থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী রেজাল্টই দ্বিতীয় বিভাগ। আমাদের সময়ে যথাসময়ে পরীক্ষা না নেয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা এক বছর পিছিয়ে যাই। আমার ক্লাসমেট তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত প্রথম বিভাগ পেয়েছিল। চতুর্থ বর্ষের একটি কোর্সে ঢাবি শিক্ষকরা খারাপ নম্বর দেয়ায় তার রেজাল্ট স্কোর থেকে কমে যায়। কিন্তু মার্কশিটে সে ৩ দশমিক ০৫ রেজাল্ট দেখেন। ফলে তিনি আর ওই কোর্সে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেননি। কিন্তু মূল সার্টিফিকেট আসার পর তিনি সেকেন্ড ক্লাস রেজাল্ট দেখেন। ঢাবি প্রশাসনের অদক্ষতায় আমার বন্ধুটির দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছে। ভুল রেজাল্টের ঘটনা শুধু আমার বন্ধুর সঙ্গেই না, আরো অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। ঢাবির শিক্ষক ও প্রশাসন থেকে আমরা বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। 

কবি নজরুল সরকারি কলেজের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী বেলাল হোসেন। ঢাবি অধিভুক্ত হওয়ার দু’বছর আগে তিনি এ কলেজে ভর্তি হন। এ শিক্ষার্থী আমার সংবাদকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ভর্তিতে কোনো ঝামেলাই পোহাতে হয়নি। ঢাবির অধিভুক্ত হওয়ার পর মাস্টার্সে ভর্তি হতে গিয়ে ঢাবির রেজিস্টার ভবনের কর্মকর্তাদের বারবার বিড়ম্বনা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যর শিকার হয়েছি। সার্টিফিকেট ওঠাতে গিয়েও একই দশা হয়েছে। ঢাবি অধিভুক্তিতে অনেকের ন্যায় আমিও খুশি হয়েছিলাম। দিন শেষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্তি ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। সাত কলেজের প্রশংসা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আক্তারুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, অতীতের তুলনায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো অবস্থায় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান মানে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠছে। যথাসময়ে ক্লাস-পরীক্ষাসহ অনেক কিছুতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের অধ্যক্ষরাও শিক্ষার্থীদের উন্নতির কথা আমাদের জানিয়েছেন। বর্তমানে শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকটসহ আরো কিছু সমস্যা আছে। শিক্ষার্থীদের ক্লাস না হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন ক্লাস করতে চায় এটিই ইতিবাচক পরিবর্তন। আগে ক্লাস হতো না।

সাত কলেজকে ঢাবির অধীনে আনার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল জানিয়ে অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘সাত কলেজের যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আছে, এত শিক্ষার্থীর এক সঙ্গে পাঠদান করা কি সম্ভব? এত শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতা, এত অল্প সময়ে কীভাবে দেখবে? কলেজগুলোর মানের সমস্যার সমাধান না করেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি একটি অর্থহীন উদ্যোগ। এর আর্থিক দিক বিবেচনা না করেই এটি নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এই কলেজগুলোকে পুনরায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়ে দেয়া উচিত। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাঠদানের পরিবেশ তৈরি করা যায় তাহলে ঢাবির অধীনে রাখা যথাযথ, অন্যথায় অর্থহীন।’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠানের মান বিশ্ববিদ্যালয়টির মতোই হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে সাত কলেজ অনেক উন্নতি করেছে। আমার এখনো সাত কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়। ওনারা আমাকে সাত কলেজের মান বাড়ার কথা জানিয়েছে। তবে সাত কলেজের এখনো অনেক সমস্যা আছে। সমস্যার সমাধানে প্রশাসনের আরো তৎপর হওয়া উচিত। ঢাবির টাকার অভাব নেই। ঢাবি চাইলে সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে। সাত কলেজের উদ্যোগটি সুন্দর। কিছু সমস্যার কারণে এটি বাদ দেয়া সমাধান নয়।