বড় পরিবর্তন আসছে না তবে ইন্টারেস্ট রেট ১ শতাংশ বাড়তে পারে
ড. আহসান এইচ মনসুর
নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির মধ্যেই দেশে অব্যাহত রয়েছে ডলার সংকট। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে রিজার্ভ ধরে রাখায় চ্যালেঞ্জের মধ্যেই রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ভাটা। এমন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই আজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিকেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন মুদ্রানীতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের প্রতিফলন থাকছে। মুদ্রানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার মতো আইএমএফের ছয়টি শর্ত ছিল। সেগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিট হিসাব প্রকাশের শর্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকি পাঁচটি শর্তের আংশিক প্রতিফলন থাকছে মুদ্রানীতিতে। এসব শর্ত পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাশাপাশি থাকছে মূল্য নিয়ন্ত্রণে অর্থ সরবরাহের কৌশল। মুদ্রানীতিতে ব্যাংকঋণের সুদের হার সামান্য বাড়বে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ডলার সংকট কাটাতে গৃহীত পদক্ষেপের কথা জানাবেন গভর্নর। তবে বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো রূপরেখা না থাকায় নতুন মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কী পদক্ষেপ থাকছে, তা নিয়ে আগ্রহ সবার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমার পরামর্শ ছিল ইন্টারেস্ট রেট যাতে পুরোপুরি তুলে দেয়া হয়। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি আর প্রাসঙ্গিক নয়। একই সাথে এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। যেহেতু বর্তমানে ইন্টার ব্যাংক এবং খোলাবাজারে লেনদেনে তেমন কোনো পার্থক্য নেই তাই দাম ধরে রাখার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না। ইন্টারেস্ট রেটে একটি মেকানিজম করবে; এতে বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশ বাড়তে পারে।’ সামগ্রিকভাবে মুদ্রানীতিতে আইএমএফের গাইডলাই গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দাম যেভাবে কমেছে, দেশে সেভাবে কমেনি। এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ডলারের বিনিময় হার বেশি। আমদানি পণ্যের দাম বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে দেশের মূল্যস্ফীতি এখন ১০ শতাংশ ছুঁঁই ছুঁই। গত এক বছরে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমে এসেছে। মূলত নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও গত এক বছরে রেপো হার বাড়িয়েছে। কিন্তু ডলারের বিনিময় হার বেশি থাকাসহ নানা কারণে তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়ছে না। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও সমাধানের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করা নেই। অবশ্য এ বিষয়ে সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেহেতু বিষয়টি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের তাই মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূতের তথ্য মতে, এবারের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব এবং মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি অনুসরণ করা হবে। কেননা, ২০১৯ সাল থেকেই অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া ছিল। ২০২০ সালে করোনার কারণে এটি প্রকট রূপ ধারণ করে। সেই মন্দার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় বৈশ্বিক মন্দা। এসব কারণে দেশের অর্থনীতিও মন্দায় আক্রান্ত হয়। এতে বিনিয়োগ কমেছে, কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলত ২০১৯ সালে বেকারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সঙ্কুুচিত হয়ে পড়েছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে এবারের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া হতে পারে। এ জন্য কিছু খাতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী চলতি জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস হিসাব প্রকাশ করলেও জুলাই থেকে রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করা হবে। তবে, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার, ডলারের একক দর নির্ধারণ ও ঋণের সুদের হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আংশিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ডলারের দাম বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। যেটি এখনো হচ্ছে। এটি একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করে সেটির দরও বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করবে। এটিও বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না। তবে বাজার দরের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ডলারের হরেক রকম দর প্রচলিত রয়েছে বাজারে। সেগুলোকে একক একটি দরে নিয়ে আসার শর্ত রয়েছে আইএমএফের। এ নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এটি এখনই কার্যকর সম্ভব হচ্ছে না। আপাতত ডলারের বিভিন্ন উপকরণের বিভিন্ন দর থাকবে।
পর্যায়ক্রমে ডলার ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য দর কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্ট চালিয়ে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণে সুদহারের সীমা তোলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও ব্যাংকগুলোর বাড়তি সুদ নেয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ‘রেফারেন্স রেট’ নির্ধার করবে। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার বিবেচনায় প্রতি মাসে এটি ঠিক করে দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত এ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) আদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণের এ করিডোর পদ্ধতিকে ‘স্মার্ট’ (শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ) নামে নামকরণ করবে বলে জানা গেছে।
আইএমএফের আরও একটি শর্ত ছিল, চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি ঋণের তথ্য বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করার পদক্ষেপ নেয়া। সেটির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নিচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর শর্তও রয়েছে তাদের। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের অনেক উপরে রয়েছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী এ প্রক্রিয়াটি ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। আগে মুদ্রানীতিতে খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনো কথা বলত না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি থেকে খেলাপি ঋণ নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতিতেও খেলাপি ঋণের বিষয়ে কড়া বার্তা থাকবে বলে জানা গেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতির অনেক লক্ষ্যমাত্রাই এখনো অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বছর শেষে এ খাতেও ঘাটতি থাকবে। চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৪ দশমিক ১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এতেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।