মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়ে সংকুলানমুখী ও আঁটসাঁট মুদ্রানীতি
—গভর্নর
সুদহার ওঠেনি বরং এক শতাংশ বাড়ানো হয়েছে
—এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
কাঠামো পরিবর্তন করে ‘সঙ্কুলানমুখী ও আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এতদিন বাজারে মুদ্রার প্রবাহ (মানি সাপ্লাই) বাড়ানো বা কমানোকে টার্গেট করে মুদ্রানীতি তৈরি করা হলেও এবার আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ইন্টারেস্ট রেট বা সুদহারকে টার্গেট করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ঋণের সুদহার তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি স্বাধীনভাবে নিতে পারেনি। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকেই সুদহার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ষান্মাসিকের জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর-২০২৩) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। এ সময় গভর্নর বলেন, ‘এতদিন মুদ্রানীতি হতো মানি সাপ্লাই টার্গেট করে কিন্তু এবার আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি। সারা পৃথিবীতে যেটা স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস; সেটা হলো ইন্টারেস্ট রেট টার্গেট করা। তাই আমরা মানি সাপ্লাই টার্গেটকে বাদ দিয়ে ইন্টারেস্ট রেট টার্গেট করে মানিটারি পলিসি করেছি। যে কারণে একটা রেট থাকবে রেপো, এর সাথে ২ পার্সেন্ট প্লাস আর ২ পার্সেন্ট মাইনাস একটা করিডোর। এটাই যাতে কলমানি রেট থাকে।’ তিনি বলেন, ‘ঋণে ৯ শতাংশ যে সুদহারের ক্যাপ দেয়া হয়েছিল তা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকেই সুদহার তুলে দেয়া হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।’
এছাড়া ভূরাজনৈতিক উদ্দেশে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে বলে মনে করেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘এই রেটিং কমানোর বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু আসে যায় না। এটা করার পেছনে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’ যদিও বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের আশায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের টার্গেট কমানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। সংবাদ সম্মেলনে পাওয়ার প?য়েন্টের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতি তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালসহ নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হাবিবুর রহমান জানান, ঋণ বিতরণের সর্বোচ্চসীমা ৯ শতাংশের বাধা তুলে দিয়ে ‘রেফারেন্স রেট’ অনুযায়ী সুদহার নির্ধারণের নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে। এসএমএআরটি (স্মার্ট-সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ) নামের এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে। কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত ও ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ সামাল দিতে আরও ১ শতাংশ যোগ করতে পারবে সুদ হারে। আর একদিন মেয়াদি রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার ৬ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপো হার (জুলাই থেকে এসডিএফ নামে পরিচিতি হবে) আগের ৪ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রেপো ও রিভার্স রেপোর এই নতুন হার ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত জানুয়ারির মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নর বলেন, এবারের মুদ্রানীতি ‘কন্ট্রাকশনারি ও টাইট’ ভঙির। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাৎ, আগে যে পদ্ধতিতে করা হতো, সেভাবেও করা হবে, আবার বিপিএম-৬ পদ্ধতিতেও করা হবে। তবে আমরা বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ হিসাব করলেও তা প্রকাশ করব না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফের এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।”
সরকারের বাজেট বাস্তবায়নকে সহায়তা করে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি সময়ে বাজারে কি পরিমাণ অর্থের প্রবাহ থাকবে তা নির্ধারণ করা হয় মুদ্রানীতির মাধ্যমে। তাতে নীতি সুদহারকে নিয়ন্ত্রণ করে বাজেটে ঠিক করা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে আর্থিক পরিবেশের কৌশল ঠিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন নীতি সুদহার। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, গত মুদ্রানীতিতে যা ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ, গতবার ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, গতবার যা ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
মুদ্রানীতির যে প্রক্ষেপণ চলতি জুন মাস শেষে অভ্যন্তরীণভাবে ধরেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তার কতটা অর্জন হয়েছে সে তথ্যও জানানো হয় মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও মে মাস শেষে অর্জন হয়েছে ৪৩.৩ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ, হয়েছে ১১.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ, আর গত মে পর্যন্ত হয়েছে ১৬.৭ শতাংশ। আর জাতীয় বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে সরকার। সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট ও জরিমানা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর জানান, কোনো ব্যাংকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা আমাদের উদ্যেশ্য নয়। আমরা চাই যারা সমস্যায় আছে তারা আবার ব্যাংক ব্যবসায় ফিরে আসুক। বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে তাদের ব্যবসায় ফেরানোর চেষ্টা করছি আমরা। আশা করি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের জরিমানা পরিশোধসহ ব্যবসায় ফিরে আসতে পারবে।
মুদ্রানীতি বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মুদ্রানীতিতে ৯ শতাংশ সুদের সীমা উঠানো হয়নি বরং ১ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আইএমএফের শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা। তিনি আরও বলেন, গত ছয় মাসের বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি, এ কারণেই হয়ত এটি কমানো হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটু বেশি কমিয়েছে এবার। এতে কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। বিনিয়োগের অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বেশি নিচ্ছে। এবারের মুদ্রানীতিতে সেই লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছে। এতে তারল্য সংকট আরও বাড়বে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার জানান, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহারের সীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুদহার ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেটি বর্তমান বৈশ্বিক অস্থির অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনায় বেশ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। পাশাপাশি এ ধরনের উদ্যোগ বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করবে।