ধন-সম্পদের মোহ ও মনের পাশবিকতা দূর করার মহান শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর আসে কুরবানি। সামান্য ত্যাগের ভেতর দিয়ে নৈকট্য লাভ করা যায় মহান রবের। সান্নিধ্য অর্জন করা যায় প্রিয় বস্তুকে তার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করে। কুরবানি শব্দটি আরবি ক্রিয়ামুল ‘কুরবুন’ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা, সান্নিধ্য অর্জন করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। এবারও মুসলিম বিশ্বে সামর্থ্যবান মুসলিম অংশ নেবেন কুরবানির আনন্দে এবং ভাগাভাগি করবেন ঈদের আনন্দ।
কোরবানির পরিচয়
শাব্দিক অর্থে কুরবানি হচ্ছে ঈদুল আজহার দিন পশু জবাই করা। শরিয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে জবাই করাই হলো কুরবানি। এটি ইসলামি শরিয়তে বিধানরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে হিজরতের দ্বিতীয় বছরে, যা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। (মাওসুয়াতুল ফিকহিল ইসলামি ওয়াল কাজায়াল মুয়াসিরা : ৩/৫৯৬)
কোরবানির ফজিলত
কুরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা মহান নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কুরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইর’ তথা অন্যতম নিদর্শন করেছি। তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। তারপর যখন (জবাই শেষে) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও-যে নিজে অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (সূরা হজ : ৩৬)। কুরবানির রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কুরবানির গোশত এবং রক্তের কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং পৌঁছে শুধু তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো, তিনি তোমাদের হেদায়েত দান করেছেন বলে। সুতরাং যারা সুচারুরূপে সৎকর্ম করে তাদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা হজ : ৩৭)
কুরবানির উদ্দেশ্য তাকওয়া ও আনুগত্যই যাবতীয় ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য। এখানে ইবাদতের বিশেষ কোনো পদ্ধতি বলা উদ্দেশ্য নয়। উপরোক্ত আয়াতদ্বয়েও এ কথাই বলা হয়েছে যে, কুরবানি একটি মহান ইবাদত কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং কুরবানির উদ্দেশ্যও এগুলো নয় বরং আসল উদ্দেশ্য হলো জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে রবের আদেশ পালন করা। অন্য সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। নামাজে কিয়াম, রুকূ ও সেজদা করা; রোজায় ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা-এগুলো আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই মূল বিষয়। আন্তরিকতা ও মহব্বত বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। এরপরও কাঠামোগুলো পালন করা জরুরি, যেহেতু তার আদেশ পালনের জন্য কাঠামোগুলো সহায়ক হিসেবে দেয়া হয়েছে। (মায়ারেফুল কুরআন : ৩৬-৩৭ আয়াতের তাফসির)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, ‘একবার কয়েকজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল কুরবানি কী?’ রাসূল সা. বললেন, ‘তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম আ.-এর সুন্নত।’ সাহাবিরা বললেন, ‘এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে?’ রাসূল সা. বললেন, ‘প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি।’ (ইবনে মাজা : ৩১২৭)
কোরবানির ইতিহাস ও প্রচলন
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কুরবানি ছিল মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম আ.-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানি। সেখান থেকেই কুরবানির প্রথম প্রচলন শুরু হয়। তবে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক আমরা যে কুরবানি করে থাকি, তা হজরত ইবরাহিম আ.-এর প্রিয় ছেলে হজরত ইসমাইল আ.-এর স্মৃতিচারণা। পবিত্র কুরআনে সূরা সাফফাতের ১০৪-১০৭ নং আয়াতে সে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে ইবনে মাজাহ শরিফের এক বর্ণনা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
শরিয়তে কোরবানির বিধান
ইসলামি শরিয়তের বিধান মতে কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানির নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করো এবং পশু জবাই করো’ (সূরা কাওসার : ২)। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আদেশসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। আর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন সাধারণত ফরজ বা ওয়াজিব হয়ে থাকে।