রেমিট্যান্সে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২৩, ০৯:৫৭ এএম
  •  ২০২২ সালে বিদেশে গেছেন রেকর্ড ১১ লাখ কর্মী
  • কর্মী বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ছে না প্রবাসী আয়
  •  হুন্ডিতে পাচার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল রেমিট্যান্স
  •  ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে জুনে

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত রেমিট্যান্সে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হয়নি। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালে রেকর্ড ১১ লাখ জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি রেমিট্যান্স খাত। ওই অর্থবছরে ১৫ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। যেখানে পাঁচ বছর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে বিএমইটির তত্ত্বাবধানে ১০ লক্ষাধিক কর্মী বিদেশে যান। যা  ছিল ওই সময় পর্যন্ত এক বছরে সর্বাধিক কর্মী বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। ফলে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পরের অর্থবছরে (২০১৯-২০) ১০ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। ওই সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। ওই বছর করোনা মহামারির কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপুল রেমিট্যান্স পাঠান।  তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সাত লাখ ৩৪ হাজার, ২০১৯ সালে সাত লাখ, ২০২০ সালে দুই লাখ ১৭ হাজার (করোনার কারণে কম) ও ২০২১ সালে ছয় লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে যায়। সবশেষ ২০২২ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে ফের রেকর্ড হয়। এক বছরে ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে যায়। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে হুন্ডির দাপটে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। গতবছর রেকর্ড কর্মী বিদেশে যাওয়ার পরও সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় পরিবার-পরিজনের জন্য বিপুল অর্থ পাঠিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হওয়ায় পরের বছর ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু আগের অর্থবছরগুলোর প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করলে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব একটা কম ছিল না। আলোচিত সময়ে এক বছর আগের অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। কিন্ত সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সে ধারা অব্যাহত থাকেনি। এর প্রধান কারণ হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা।

গতকাল প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১৬১ কোটি বা ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়িন ডলার। যা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৫৮ কোটি ডলার বেশি; প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ১০৩ কোটি বা ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল রেকর্ড দুই হাজার ৪৭৮ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি বা ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৬৪২ কোটি বা ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।     

মূলত একসময় রেমিট্যান্স আহরণের বড় উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কিন্তু বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে এসব দেশ থেকে বিপুল অর্থপাচার হয়ে কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ দুবাইতে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে রেমিট্যান্স আয়ের প্রধান উৎস এখন যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সে সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে গেছে দেশটি। তবে কোরবানি ঈদের মাস হওয়ায় অর্থবছরের শেষ মাস জুনে চাঙ্গা হয়েছে প্রবাসী আয়। গত মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২২০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। যা আগের ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর এ যাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে, এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্সে চাঙ্গাভাবের মধ্যে ঈদের আগে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির ঋণের ৫২ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে আবার ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মাঝে যা ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে থেমে থেমে ডলারের দর বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দেয়া হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি রপ্তানি বিল কেনার দর ৫০ পয়সা বাড়িয়ে গতকাল থেকে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা কার্যকর করেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল কেনার গড় দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া আন্তঃব্যাংকে কোনো ব্যাংক আর ১০৯ টাকার বেশি দর নেবে না। আর আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলার কেনা ও বিক্রির একক দর বা সিঙ্গেল রেট কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও এর আগে ১ জুলাই থেকে একক দর কার্যকরের কথা বলা হয়েছিল।