দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে মামলা কিন্তু সেই অর্থে নিষ্পত্তির সংখ্যা অতি সামান্য। তার ওপরে যে মামলায় একবার জামিন হয় সেও হয় পলাতক। একের পর এক নতুন মামলা আর জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়া আসামিদের ধরতে হিমশিম খায় পুলিশ। ঢাকাসহ সারা দেশে জামিন নিয়ে পলাতক আছে প্রায় লাখ ছুঁঁই আসামি। এদের অধিকাংশই জিআর (জেনারেল রেজিস্টার) ও সিআর (কোর্ট রেজিস্টার) মামলার আসামি। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, লাপাত্তা প্রায় ৫০ হাজার আসামির মধ্যে জিআর মামলার ২৭ হাজার ৯৫১ এবং সিআর মামলার ওয়ারেন্ট ১২ হাজার ৮৫২টি। এ ছাড়া ১০ মাসে আদালত থেকে ডিএমপির ও বিভিন্ন জেলা পুলিশের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে আরও প্রায় সাত হাজার ৪৪৭টি। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তাদের গ্রেপ্তারে জোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে । অবশ্য পুলিশের একটি সূত্রের দাবি— ফেরারি এসব আসামির মধ্যে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠন এবং সমমনা দলের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। তারা বাসায় অবস্থান না করার কারণে তাদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।
রাজধানীর ৫০ থানার প্রায় সবগুলোতেই অসংখ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে কিন্তু অধিকাংশের বিষয়ই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই থানা পুলিশের কাছে। এ বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ওয়ারেন্ট বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিদিন যে পরিমাণ ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়, তার চেয়ে তিনগুণ নতুন ওয়ারেন্ট আসে। এ কারণে ডিএমপি ৫০টি থানায় বিপুল ওয়ারেন্ট পেন্ডিং রয়েছে। এসব ওয়ারেন্ট কীভাবে দ্রুত তামিল করা যায়, সে বিষয়ে পরবর্তী ক্রাইম কনফারেন্স সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরোয়ানাপ্রাপ্ত কোনো আসামির সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশের অন্তত অর্ধলাখের বেশি আসামির হদিস মিলছে না। তাদের মধ্যে জঙ্গি, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ নানা অপরাধের আসামি রয়েছে। ওইসব আসামির আদালতে নিয়মিত হাজিরা দেয়ার কথা থাকলেও তারা অনুপস্থিত। যেসব আসামির খোঁজ মিলছে না তাদের খুঁজে বের করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এলাকাভিত্তিক তালিকা করতে থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ সুপাররা। এরই মধ্যে তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতিদিনই আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আসছেন বিভিন্ন মামলার আসামিরা। জামিন মিললেও তাদের ধার্য তারিখে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধী থেকে শুরু জঙ্গি কিংবা বড় অঙ্কের প্রতারণার মামলার আসামিরা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন না বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাদের হয়ে উকিল বারবার সময় চেয়ে নিচ্ছেন আদালত থেকে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। গত ১০ বছরের ব্যবধানে লাপাত্তা প্রায় ৫০ হাজার আসামি কোথায় আছেন তা চিহ্নিত করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। এমনকি অনেক আসামি জামিন নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে, তাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তার কথাও বলছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘জামিন নিয়ে অনেক অপরাধী নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না, তা সত্য। যেকোনো আসামি জামিন নেয়ার সময় শর্ত দেয়া হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যাচ্ছে জামিনের পর অনেকেই শর্ত মানে না। যারা জামিনের শর্ত মানছে না তাদের আইনজীবীদের শোকজের আওতায় আনা প্রয়োজন। এ জন্য আমরা কাজ করছি। পুলিশের কাছে তথ্য আছে— রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া এলাকায় সক্রিয় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-জনযুদ্ধ), কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহকেন্দ্রিক নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (শৈলেন গ্রুপ), ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকায় গড়ে ওঠা শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (গাজী-কামরুল), বাংলাদেশ নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মৃণাল), গণমুক্তি ফৌজ, পাবনা ও কুষ্টিয়া এলাকায় সক্রিয় গণবাহিনী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-রশিদ), সর্বহারা পার্টির বরিশাল, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী গ্রুপ নামে সক্রিয় থাকা তিন অংশের অন্তত তিন হাজার আসামি জামিন পেলেও নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না। তবে সমপ্রতি এসব চরমপন্থিদের একটি বড় অংশ র?্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ওই তালিকায় থেকে যাচাই-বাছাই করে নতুন করে তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি যে পাঁচ থানায় ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে : মে মাস পর্যন্ত ঝুলে থাকা ৪১ হাজার ৩৪৮টি ওয়ারেন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ওয়ারেন্ট ঝুলে রয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। গত মে মাস পর্যন্ত ওই থানায় পাঁচ হাজার ৮৪৯টি ওয়ারেন্ট ঝুলে ছিল। অর্থাৎ আদালতের পরোয়ানা থাকলেও ওই থানায় ওই সংখ্যক আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এর পরই মিরপর থানায় তিন হাজার ১৬টি, পল্লবী থানায় দুই হাজার ৭১৪টি, যাত্রাবাড়ী থানায় দুই হাজার ২৭৩টি এবং কাফরুল থানায় এক হাজার ৪২৮টি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে।
সবচেয়ে কম ওয়ারেন্ট যে পাঁচ থানায় : থানায় জমা পড়া ওয়ারেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মে মাস পর্যন্ত বিমানবন্দর থানায় সবচেয়ে কম ৩০টি ওয়ারেন্ট ঝুলে ছিল। এর পর উত্তরা-পূর্ব থানায় ৭৩টি, উত্তরখান থানায় ১৪২টি, ক্যান্টনমেন্ট থানায় ১৪২টি এবং নিউমার্কেট থানায় সর্বনিম্ন ১৯১টি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে। পরোয়ানা ইস্যুর চেয়ে নিষ্পত্তি কম : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানাগুলোতে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পরোয়ানা ইস্যু হয়, মাসে গড়ে তার মাত্র ২৫ ভাগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। প্রতি মাসেই ইস্যু করা ৭৫ ভাগ ওয়ারেন্ট ঝুলে থাকছে।