রুপিতে লেনদেনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আজ

ডলারে স্বস্তির আশা নেই

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুলাই ১১, ২০২৩, ১২:০২ পিএম
  • বিনিময় হার নিয়ে ধোঁয়াশা দুর্বল হতে পারে টাকা
  • শঙ্কায় রপ্তানিকারকরা, ব্যয় কমবে ভ্রমণকারীদের

বাংলাদেশের স্বার্থ স্পষ্ট নয় বরং ভারতের রাজনৈতিক বিজয়

—ড. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ

আমদানি-রপ্তানি নিতান্তই ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড হলেও যেকোনো দেশের জন্য বাণিজ্য কূটনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাণিজ্য প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে লেনদেন হলেও এর পাশাপাশি ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে লেনদেন শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছে আজ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কূটনীতিতে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সর্বাধিক প্রাধান্য পাওয়ার কথা থাকলেও রুপিতে লেনদেন শুরুর প্রক্রিয়াকে ভারতের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের ব্যয় কিছুটা সাশ্রয়ের আশা থাকলেও রপ্তানি বাণিজ্যে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ভারতের সাথে রুপিতে লেনদেন কিভাবে হবে তা স্পষ্ট নয়। বিনিময় হার নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। টাকা, ডলার ও রুপির বাজারমূল্য ধরে দর নির্ধারিত হবে; নাকি ব্যাংক-গ্রাহক আলোচনার ভিত্তিতে হবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। এ ক্ষেত্রে রুপির বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।’ রুপিতে লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্ধারিত কোনো গাইডলাইন  এখনো দেয়া হয়নি। লেনদেন করতে গিয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। যেহেতু লেনদেন হবে শুধু রুপিতে তাই ব্যবসায়ীদের টাকা দিয়ে রুপি কিনতে হবে। এ রুপি আসবে রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে। যেহেতু ভারত তাদের রপ্তানি মূল্য টাকায় নেবে না, তাই ডলার বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। ফলে চলমান ডলার সংকটে রুপির লেনদেন কোনো স্বস্তি আনবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কেন এ প্রক্রিয়ায় সম্মত হলো তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। বাণিজ্যিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এ নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। 

এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু শুধু ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেন হবে তাই ডলারের ওপর চাপ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ অস্পষ্ট। বিপরীতে ভারতের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে তাদের মুদ্রা শক্তিশালী হবে।’ নতুন এ বাণিজ্য নীতির ফলে রপ্তানি আয় বাবদ যে পরিমাণ রুপি আসবে, সমপরিমাণ আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে ব্যাংক। তবে বাকি আমদানি ডলারে হবে নাকি রুপিতে, এ বিষয়ে স্পষ্ট গাইডলাই নেই। জানা গেছে,  স্বল্পমেয়াদি রুপির ঋণ নিয়ে আমদানি করা যাবে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ আমদানি রুপিতে হওয়ার বিষয়টি কিভাবে সমন্বয় হবে তাও স্পষ্ট নয়। একজন ব্যবসায়ী কি পরিমাণ আমদানি রুপিতে, আর কি পরিমাণ ডলারে করবেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এর ছাড়পত্র নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। এতে নতুন ঝামেলায় পড়বেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে রপ্তানিকারক অর্জিত রুপি অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। নির্ধারিত ব্যাংকে বিক্রি করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় দর নিয়ে ঝামেলায় পরতে হবে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতদিন একজন ব্যবসায়ী ভারতে কাপর রপ্তানি করে ওই ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে মেশিন কিনতে পারতেন। এখন তাকে প্রথমে ডলার ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে টাকা নিতে হবে, এরপর আবার টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি জটিলতার পাশাপাশি মুদ্রা বিনিময়ে লোকসান হতে পারে। অথবা রুপির ক্রেতা না থাকলে এ অর্থ বসিয়ে রেখে আমদানিতে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণকারিরা সুবিধা পাবেন। বারবার মুদ্রা বিনিময় না করে সরাসরি রুপি লেনদেন করতে পারবেন তারা। এতে বিনিময় করতে গিয়ে যে বাড়তি খরচ ও ঝামেলা হতো তা থেকে এখন নিস্তার পাওয়া যাবে। 

ব্যাংকাররা জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো বাণিজ্য হয়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে আগের মতোই ডলারই হবে প্রধান মুদ্রা। এর সঙ্গে রুপিতেও লেনদেনের একটি ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের সোনালী, ইস্টার্ন ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে রুপিতে লেনদেন করতে পারবেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। ভারত অংশে এ সম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্বে থাকবে দেশটির আইসিআইসি ব্যাংক এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। রুপিতে লেনদেনের চাহিদা বাড়লে পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংককেও অনুমতি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এ প্রক্রিয়া জনপ্রিয় না হলে নতুন কোনো ব্যাংকে এ লেনদেন চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে দুটি ব্যাংকের কাছে ব্যবসায়ীদের জিম্মি হওয়ার মতো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ আমদানির বাধ্যবাধকতা আরোপ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহক নির্বাচন প্রক্রিয়াও জটিল হবে। 

একক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার : বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ নীতি প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করেনি সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়ে নীরব। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এ আঞ্চলিক অর্থনীতিতে রুপির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে ভারত। বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে নিয়ে প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলোতে এ নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে তারা। 
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও রুপিতে লেনদেনে সম্মত হওয়ার সিদ্ধান্ত সুচিন্তিত হয়েছে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভারত তাদের মুদ্রার আধিপত্য বিস্তারের কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করেছে।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘রুপিতে লেনদেন ইস্যুটা যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে ভারতীয় মুদ্রা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার হবে। এ প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ 
তথ্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে আজ ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রুপিতে লেনদেনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর, বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি, ভারতীয় হাইকমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আমদানির বড় অংশ হয় চীন ও ভারত থেকে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত মোট আমদানির ১৯ শতাংশের বেশি এসেছে ভারত থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার বা মোট আমদানির ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত চীন থেকে এসেছে মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানান, ডলারের ঋণ এখন অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তাই  ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বিদেশি ঋণে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আবার কিছু ব্যাংকের ক্রেডিট লাইন কমাসহ বিভিন্ন কারণে কেউ কেউ চাইলেও আগের মতো আর ঋণ পাচ্ছেন না। এসব কারণে গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার কমে ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। গত বছরের জুনের তুলনায় যা ৩৭৭ কোটি ডলার কম। এতে বাণিজ্য ঘাটতি এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি অনেক কমলেও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে এখন ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের নেমেছে। দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত যেকোনো ব্যাংক শাখা থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল (আইএমএফ) স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা এবং কানাডিয়ান ডলারে এলসি খুলতে পারে। এ জন্য আলাদা করে কোনো ব্যাংকের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আইএমএফ স্বীকৃত পাঁচটি মুদ্রা হলো— ইউএস ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও চায়নিজ রেনমিনবি। ২০১৬ সাল থেকে চীনের মুদ্রা আইএমএফ স্বীকৃত হলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০১৮ সাল থেকে ইউয়ানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি রয়েছে। তবে ডলারের বাইরে ইউয়ানসহ অন্য মুদ্রায় লেনদেনে এখনো তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি।

আঞ্চলিক বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব কমাতে বেশ আগে থেকে চেষ্টা করে আসছে বড় দেশগুলো। বিশেষ করে ভারত, চীন ও রাশিয়া নিজেদের মুদ্রা লেনদেনের জন্য অনেক দিন ধরে আলোচনা করছে। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। এর পর নতুন করে নিজ দেশের মুদ্রার প্রচলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। যদিও ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক সতর্ক।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে : রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়ায় ডলারের চাহিদা কিছুটা হলেও কমবে। অন্যদিকে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো বাংলাদেশকে অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক কূটনীতি কেমন হবে জানতে চাইলে ড. জাহিদ বলেন, ‘রুপির লেনদেন শুরুর প্রক্রিয়াকে ডলারের আধিপত্য কমানোর স্লোগানের সাথে গাঁ ভাসানোর মতোই মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতার পাশাপাশে ভারত প্রীতিও হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ ভারত-বাণিজ্যে ডলারের লেনদেন খুবই কম তাই যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে তারা বিষয়টি অন্যভাবে পুষিয়ে নিতে পারে।’