যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া ডকুমেন্টে রয়েছে ১৫ বছরে ৯২ হাজার গ্রেপ্তার, ২৪৬ নেতাকর্মী নিহত, ৯৬ হাজার নেতাকর্মী আটক ও পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে পঙ্গু
রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হলো জামায়াত, এটা সবাই মনে করছে
—মতিউর রহমান আকন্দ
সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতকে স্বাগত, তাদের কর্মসূচির সঙ্গে মূল লক্ষ্য এক
—এমরান সালেহ প্রিন্স
সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতকে ব্যবহার করছে
—রুহিন হোসেন প্রিন্স
সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকল্প শক্তিও মনে করা হচ্ছে। কূটনৈতিক মিশনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের গুরুত্ব দৃশ্যত। দীর্ঘ ১৫ বছর আত্মগোপনে থাকা দলটি আবারও প্রকাশ্যে আসায় ভোটের সমীকরণে অনেক হিসাব দাঁড়িয়েছে। আগামীকাল সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে ওইদিনই সিলেট থেকে শুরু হচ্ছে সরকার পতনে ১০ দফা ও মৌলিক তিন দফায় সমাবেশ। মহানগরীতে সমাবেশের পর জেলা সদরেও সমাবেশ করবে জামায়াত। এরপর ঢাকায় বৃহৎ সমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য দেয়া হবে নতুন ঘোষণা। ওই সমাবেশে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানও প্রকাশ করবে দলটি। সারা দেশ থেকে ১০ লাখ লোকের উপস্থিতির পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
ভিসানীতির পর গত ১০ জুন রাজধানীতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। এরপর গত ৭ জুলাই সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীর মিরপুরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে জামায়াত। দুটো কর্মসূচিতে কয়েক হাজার নেতাকর্মী যোগ দেয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরেও জায়গা পায় জামায়াত। হঠাৎ রাজপথে জামায়াতের এই ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দোষারোপ করছে বামপন্থি রাজনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের বড় দুটি দল নিজেদের স্বার্থে জামায়াতকে ব্যবহার করছে, যা ৭২ এর সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যে কোনো মুহূর্তে একটি পরিস্থিতি দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে জামায়াত। এর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দায় নিতে হবে। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে ভিন্ন কথা। আন্দোলন সফলে এবার জামায়াতকেই বেছে নেয়া হয়েছে। বিএনপির ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে এবার ভোটের হিসাবেও জামায়াতের অবস্থান যুক্ত করা হয়েছে।
দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সফল আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে রাজপথে নামবে। একই সঙ্গে তারা সারা দেশে সমাবেশের মাধ্যমে ভোটের প্রস্তুতিও শেষ করবে। আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়ন করে তারপর নির্বাচনে যাবে। দেশের বর্তমান অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা, নাগরিক অধিকার অনিশ্চিত থাকায় তাদের আন্দোলনের সঙ্গে দেশের মানুষ থাকবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া দলটির প্রচার বিভাগ বলছে, গত ১৫ বছরে তাদের ৯২ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সরকারের আমলে ২৪৬ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছে তাদের। ৯৬ হাজার নেতাকর্মীকে বিভিন্নভাবে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। সমপ্রতি বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে জামায়াতের গুম-খুনের বিষয়টি প্রকাশ পায়। আর জামায়াত তাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি ডকুমেন্ট আকারে কূটনৈতিক দরবারেও পৌঁছায়। বিশেষ করে বই আকারে এর একটি তালিকা যুক্তরাষ্ট্রকেও দেয়া হয়।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াতের কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের বৃহৎ সংখ্যক নাগরিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ নজরে রয়েছে। বিএনপি যদি কোনোভাবে আন্দোলনে ব্যর্থ হয় তাহলে জামায়াত শেষবেলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলবে। জামায়াতকে যে বিদেশি শক্তিগুলো উৎসাহ দিচ্ছে তা সহজেই অনুমান হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রকে সমপ্রতি জামায়াত বিশেষ ডকুমেন্টারি দিয়েছে তারা সেটি গুরুত্বের সঙ্গে পজেটিভ নিয়েছে। আগামীকাল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠকে প্রমাণ হচ্ছে রাজনীতিতে জামায়াত এবার ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণেও যাচ্ছে জামায়াত। আন্দোলন ও সমাবেশ বাস্তবায়নে এবার অনেকেই যে এ দলটিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে এটি অনেকেই ধারণা করছেন।
একটি কূটনৈতিক সূত্রের দাবি, এক দফার আন্দোলনে যে বিএনপি সফল হবে তা অনেকেই ভরসা করতে পারছে না। তাই জামায়াতকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। জামায়াতের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ নাগরিকের আস্থা বেড়েছে। তারা নিজস্ব জরিপেও পেয়েছে অতীতের চাইতে তাদের অনেক ভোট বেড়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে মানুষকে সঙ্গে পাবে বলেই মনে করছে। আগামীকাল ১৫ জুলাই সিলেট মহানগরে সমাবেশের মধ্য দিয়ে তাদের নতুন আন্দোলনের যাত্রা। এরপর পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ অন্যান্য মহানগরীতেও সমাবেশ করবে দলটি। চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা আসবে ঢাকা থেকে। সেখানে দেয়া হবে অল্প সময়ের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগে আল্টিমেটাম।
জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ আমার সংবাদকে বলেন, প্রথমত জামায়াতে ইসলামীর সুস্পষ্ট ঘোষণা কেয়ার টেকার সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ জামায়াতকে ইসলামী সংগঠন হিসেবে, রাজনীতি ও গণতন্ত্র রক্ষায় দলের ভূমিকা, দুজন মন্ত্রীর দ্বারা পরিচালিত তিনটি মন্ত্রণালয় অতীতে জামায়াতের যে পারফরমেন্স এজন্য দেশের ভোটাররা জামায়াতের ওপর পজেটিভ। জামায়াতকে নেতৃত্বে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এ সরকারের আমলে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। এর হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। এজন্য রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হলো জামায়াত— এটা এখন সবাই মনে করছে।
কূটনৈতিকদের গুরুত্ব সম্পর্কে আকন্দ বলেন, আপনারা জানেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তাদের সেই উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবে। প্রশাসনের সাথে কথা বলবে। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতের সঙ্গে কথা বলবে। আমরা আমাদের রাজনৈতিক ভিউকে সামনে রেখে বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে আমাদের বক্তব্য তাদের সামনে উপস্থাপন করব।
সমাবেশ প্রসঙ্গে জামায়াতের এই নীতিনির্ধারক বলেন, সিলেটের যে সমাবেশ সেটা একটা রাজনৈতিক সমাবেশ। আমাদের ঘোষিত সরকার পতনে ১০ দফা। প্রধানত মৌলিক তিন দফা নিয়েই সমাবেশ। কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন, শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মুক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ— এ দাবিতে। পর্যায়ক্রমে সব মহানগরীতে সমাবেশ হবে বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেন, জামায়াতে ইসলাম যে উদ্দেশ্যে নিয়ে আন্দোলনে নামছে, কর্মসূচি দিচ্ছে, সেটার সঙ্গে আমাদের মূল লক্ষ্য এক। তাই আমি জামায়াতে ইসলামীর কর্মসূচির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কারণ এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এই সরকার থাকলে মানুষের জানমাল নিরাপদ নয়, তাই এই সরকারকে বিদায় করা, কেয়ার টেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করা, এ উদ্দেশে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দফার আন্দোলনে নেমেছি। আমরা মনে করি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি বা জামায়াতে ইসলামী যে আন্দোলন করছে এই আন্দোলন সফল হবে।
তবে জামায়াতের ভূমিকায় ভিন্ন কথা বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধী এটি প্রমাণিত। আমরা দেখি বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি তাদের ব্যবহার করে, যা ৭২ এর সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, জামায়াতে ইসলামী যদি দেশের মধ্যে আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে এর দায়ভার বর্তমান সরকারকে নিতে হবে বা যাদের সঙ্গে ঐক্য করে রাজপথে নামবে তাদের দায় নিতে হবে।