হতাশায় শুরু অর্থবছর
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এ গুরুত্বপূর্ণ খাতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে জনশক্তি রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হতাশাজনক। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ সব সূচকেই কমেছে। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসতে শুরু হওয়ার যে আলোচনা ডালপালা ছড়িয়েছে তারও কোনো বাস্তবতা নেই; পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। সম্প্রতি সুইস ব্যাংক থেকে সরানো বাংলাদেশিদের বিপুল অর্থও দেশে আসেনি। প্রণোদনা ও নীতি সহায়তাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েও হুন্ডির দাপট কমাতে ব্যর্থ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিযানও ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারেনি এ খাতে।
গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল। প্রবাসীরা আগের ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছিল এই মাসে। তবে পরের মাসেই তা থমকে দাঁড়িয়েছে। গত জুলাই মাসে ফের রেমিট্যান্স কমেছে। জুলাইয়ে প্রবাসীরা ১৯৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগের মাস জুনে যা ছিল ২১৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ২২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত মাসে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়েও রেমিট্যান্স কমেছে। গত বছরের একই সময়ে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২০৯ কোটি মার্কিন ডলার। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ১২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জুনে ঈদুল আজহার কারণে প্রবাসীরা রেকর্ড রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। জুলাইয়ে আবার এ প্রবাহ কমে গেছে। এটা স্বাভাবিক মনে হলেও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে যাওয়া খারাপ বার্তা দিচ্ছে। নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম মাসে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ জরুরি পণ্যের চাহিদা মেটাতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার লাগাম টেনেও বকেয়া দায় থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ ৩৭ হাজার জনশক্তি বিদেশে গেছে। এ সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি এবং আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। অথচ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় পরিবার-পরিজনের জন্য বিপুল অর্থ পাঠিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হওয়ায় পরের বছর ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু আগের অর্থবছরগুলোর প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণ করলে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব একটা কম ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ১৬১ কোটি বা ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়িন ডলার। যা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৫৮ কোটি ডলার বেশি; প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ১০৩ কোটি বা ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল রেকর্ড দুই হাজার ৪৭৮ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি বা ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল এক হাজার ৬৪২ কোটি বা ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। মূলত একসময় রেমিট্যান্স আহরণের বড় উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কিন্তু বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে এসব দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ দুবাইতে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে রেমিট্যান্স আয়ের অন্যতম উৎস এখন যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সে সৌদি আরবকে টেক্কা দিচ্ছিল দেশটি। এ কারণে পাচার হওয়া অর্থ যুক্তরাষ্ট্র হয়ে দেশে আসতে শুরু করেছে বলে আলোচনা ডালপালা ছড়ায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আসে ২৪ কোটি ডলার। যা কয়েক মাস আগের চেয়ে কিছুটা কম। অন্যদিকে জুনে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৪০ কোটি ডলার। যা আগের মাসগুলোর তুলনায় প্রায় ১০ কোটি ডলার বেশি। তথ্য অনুযায়ী সুইস ব্যাংক থেকে বাংলাদেশিদের সরানো বিপুল অর্থও দেশে আসেনি। কারণ রেমিট্যান্স বেশি আসে এমন শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই তালিকায় সুইজারল্যান্ডের নাম নেই।
গত ২২ জুন প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের অর্থ প্রায় ৮২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে। বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১২১ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রণোদনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে থেমে থেমে ডলারের দর বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ১০৯ টাকা দেয়া হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি রপ্তানি বিল কেনার দর এক টাকা বাড়িয়ে গতকাল থেকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা কার্যকর করেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল কেনার গড় দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করার সুযোগ থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত করিডোরের কারণে নতুন নিয়ম অনুযায়ী আমদানিকারকদের কাছ থেকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সার বেশি দাম নিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এছাড়া আন্তঃব্যাংকে কোনো ব্যাংক আর ১০৯ টাকার বেশি দর নিতে পারেন না। আর আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলার কেনা ও বিক্রির একক দর বা সিঙ্গেল রেট কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও এর আগে ১ জুলাই থেকে একক দর কার্যকরের কথা বলা হয়েছিল।
তবে এসব পদক্ষেপ হুন্ডির দাপট কমাতে খুব একটা কাজে আসছে না। তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরিচালিত অভিযানও হুন্ডির লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় ও ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে হুন্ডি চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে পাচারকারিরা। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি জানিয়েছে, দেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপগুলো অর্থপাচারে জড়িত।