সচিব ও ডিজিরা চাইলে চার-পাঁচ মাসেই মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যায়
—এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার সাবেক সচিব
শাস্তি না হলে অন্যায় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে
—ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক, ঢাবি
অভিযোগ প্রমাণে যথেষ্ট তথ্য থাকে না
—ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
সরকারি চাকরিতে অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু অপরাধ প্রতিরোধে স্পষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় একই ধরনের অপরাধ করেও আলাদা আলাদা শাস্তি পাচ্ছে কর্মকর্তারা। কেউ অল্প অপরাধে বেশি শাস্তি পাচ্ছে। অর্থাৎ ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ ভোগ করছেন। আবার কেউ বেশি অপরাধ করেও শাস্তি পাচ্ছেন নামে মাত্র। অবশ্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তাদের অধিকাংশই থাকছেন শাস্তির বাইরে। আবার যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হচ্ছে, সেসব মামলা নিষ্পত্তিতেও নেই নির্দিষ্ট সময়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচিব ও ডিজিরা চাইলেই চার-পাঁচ মাসেই মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যায়। বড় অপরাধে ছোট শাস্তি দেয়া উচিত না। যদি ন্যায় শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে দুর্নীতি ও হয়রানি বাড়বে। তবে প্রশাসনে দায়িত্বরতরা বলছেন, অনেক সময় অভিযোগ এলেও সেটি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য থাকে না। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগে, সে জন্য বিচারে সময় লাগছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতি, অসদাচরণ, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ ও অনৈতিক কার্যকলাপ এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে বছরে হাজারের উপরে অভিযোগ জমা পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়। প্রাথমিক তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর বিভাগীয় মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেসব বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তিতে হতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। সময়মতো ও দ্রুত এসব তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে থাকাসহ নানা জটিলতার শিকার হন।
বড় অপরাধে সরকারি কর্মকর্তারা পাচ্ছেন ছোট শাস্তি। জানা যায়, চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোজিনা আখতারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সহকর্মীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম প্রহরীকে দিয়ে বাড়িতে সার্বক্ষণিক কাজ করানোসহ ১২টি অভিযোগ আনা হয়। এরপর ১২ অক্টোবর, ২০২২ চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ড. মো. শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে লঘুদণ্ড ‘তিরস্কার’ প্রদান করা হয়।
বিদ্যালয়ের একাধিক সহকারী শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক রোজিনা আখতারের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, শৃঙ্খলাবিধি লঙ্ঘনসহ ডজনখানেক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না। আমরা প্রতিনিয়ত হুমকির শিকার হচ্ছি। কোনো প্রকার শাস্তি না হওয়ায় অপরাধে আরও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সব প্রমাণের ভিত্তিতে, বিধি-বিধান মেনেই তাকে লঘুদণ্ড ‘তিরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে।
অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে গত ২৭ অক্টোবর সারোয়ার সালাম নামের প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তাকে ‘তিরস্কার’ এর লঘুদণ্ড দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অন্যদিকে প্রাথমিকের প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণে ‘অস্বীকৃতি’ জানিয়ে সাক্ষাৎকার প্রদান ও অন্যদের সাক্ষাৎকার দানে উৎসাহিত করায় তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আচরণ পরিপন্থি অভিযোগ আনা হয়। এরপর গত ১৭ মে তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাদের আপিলের আড়াই মাস পার হলেও এখনো কোনো সমাধান আসেনি।
এ ছাড়াও একই অপরাধে দুজনকে ভিন্ন শাস্তিও দেয়া হয়েছে। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি ও তদারকির অভিযোগে দুজনকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়। দুজনের অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। কিন্তু একজনকে শুধু তিরস্কার দেয়া হয়। আরেকজনের গ্রেড অবনমন করা হয়। জানা যায়, গত ২৭ অক্টোবর বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. সাইফুল ইসলামকে নবীন কর্মকর্তা ও চাকরিতে অভিজ্ঞতা কম থাকার কথা বলে তিরস্কারের দণ্ড দেয়া হয়। একই অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সাবেক ইউএনও রুমানা আক্তারের বেতন গ্রেড অবনমন করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলাগুলোর বিচারে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সম্প্রতি এ বিষয়ের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
গত ২ আগস্ট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক মনীষা চাকমা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত ৪১৮ প্রাথমিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত বিভাগীয় মামলা আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে সমাধান করার অনুরোধ করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগ) ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই ধরনের শাস্তি হওয়ার বিষয়টি জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ এলেও সেটি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য থাকে না। দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে বিচারের বেশি সময় লাগে। তবে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হলে অনেক সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যান। সে জন্য সময়ও নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্যায়ের যথাযথ শাস্তি না হলে অন্যায় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে অপরাধ আরো বেড়ে যায়। অন্যরাও অপরাধ করতে উৎসাহ পায়। বিভাগীয় কমিশনারের যেকোনো শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। তবে কারো দুই বা ততোধিক শাস্তি হলে আপিলে তাদের একটি শাস্তি কমানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথমবারের অভিযোগের ক্ষেত্রে তিরস্কার করা যেতে পারে। কিন্তু বারবার অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে তাকে গুরুদণ্ডও দেয়া যেতে পারে। নারীঘটিত অপরাধ ও তহবিল তছরূপ কঠিন শাস্তি যোগ্য অপরাধ। যদি এই বিষয়গুলো প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের গুরুদণ্ডের আওতায় আনা উচিত। তবে এই ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য ও প্রমাণ থাকা লাবে।
সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, বিষয়গুলো সম্পূর্ণ দায়িত্ব সচিব ও ডিজিদের ওপর। ওনারা চাইলেই চার-পাঁচ মাসের মধ্যে এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে পারেন। এ জন্য মামলা পরিচালনাকারীদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। বড় অপরাধে ছোট শাস্তি দেয়া উচিত নয়। যদি ন্যায় শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে দুর্নীতি ও হয়রানি বাড়বে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। আবার একই ধরনের মামলায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণের ওপরও শাস্তি দেয়া হয়। কোনো মামলায় আত্মসাতের পরিমাণ বেশি হলে তাদের শাস্তি বেশি হয়। আবার কারো কম হলে তারা কম শাস্তি পান।