জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা সমীকরণ চলছে। যেটি সব জাতীয় নির্বাচনের আগেই হয়ে থাকে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বলা যায়, প্রায় সব সংসদ নির্বাচনেই অধিকাংশ ছোট দল বড় দলের সাথে দৃশ্য অথবা অদৃশ্য সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ১৯৯৯ সালের পর এসে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে জোট-মহাজোট গঠন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেও এমন নানা সমীকরণ হয়েছে। তখন বিএনপি ২০ দলীয় জোটের ওপর ভরসা কমিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। আবার ২০ দলীয় জোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এনডিপি। ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর ঘোষণা দিয়ে তারা জোট ছাড়ে। পরবর্তীতে তারা অধ্যাপক ডাক্তার একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি জোটে অংশ যোগ দেয়। এ ছাড়াও ২০১৮ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে এসে ডা. চৌধুরীর হাতে ফুল দিয়ে দলে তার দল বিকল্প ধারা বাংলাদেশে যোগ দেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা শমসের মবিন চৌধুরী, ছাত্রদলের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন, সাবেক মন্ত্রী (এরশাদ সরকার) নাজিম উদ্দিন আল আজাদ। সে সময় এভাবেই ঘটে নানা ঘটনা।
মূলত নির্বাচনে বিজয়ী হতে বড় দলগুলো নানা কৌশল করে থাকে। ছোট দলগুলোও কৌশলী ভূমিকায় থাকে। মাঠে ফাইট করার মতো যথার্থ সামর্থ্য না থাকার কারণে ছোট দলগুলো বড় দলের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের প্রধান দুই শক্তিমান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে ছোট দলগুলো নানা তৎপরতা চালায়। বড় দলগুলোও নিজেদের সুবিধা অসুবিধা মাথায় রেখে কাউকে কাছে টেনে নেয় আবার কাউকে দূরে ঠেলে দেয়। একাদশ নির্বাচনের আগে পুরো বছরজুড়েই চলে এমন নানা সমীকরণ। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এবারও দলগুলো ঠিক একই তৎপরতা চালাচ্ছে। বছরের প্রথম দিক থেকেই নানা সমীকরণ শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের নির্বাচনি জোট রয়েছে। ওই জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত বছরের মার্চে বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি বলে ১৪ দলের শরিকরা গোপনে এবং প্রকাশে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাতেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ খুব একটা পাত্তা দেয়নি, জোট নেতাদের ক্ষোভকে আমলে নেয়নি। এভাবে কেটে যায় আরও ১৬ মাস। কিন্তু নির্বাচন যখন ঘনিয়ে এসেছে তখন কিন্তু সেই অবস্থানে থাকেনি আওয়ামী লীগ।
কয়েক দিন আগে (১৯ জুলাই) ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গণভবনে সে দিন বৈঠকের পর চাঙ্গা হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের অভিমান ভুলিয়ে দেন। ওই বৈঠকের পর ইতোমধ্যে রাজপথে একাধিক কর্মসূচি পালন করে সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছে দীর্ঘদিন ঘুমন্ত থাকা ক্ষমতাসীন এই জোট। এই ১৪ দলীয় জোটে আজও একটি সভা করবে। আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী’ উপলক্ষে একটি স্মরণসভা করবে কেন্দ্রীয় ১৪ দল। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু এমপি।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে থেমে নেই বিরোধী দলগুলোও। অর্থাৎ বিরোধী শিবিরেও চলছে নানা সমীকরণ। এখানেও দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য নানা সমীকরণ চলছে। গত নির্বাচনে যে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে’ ব্যানারে এবং ফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিরোধী দলগুলো, সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভোটের পর আর সক্রিয় হয়নি। ফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি ইতিহাসের ভয়াবহ ফল দেখেছে। বিএনপি সিনিয়র নেতা এবং দলটির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তো প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন ড. কামাল হোসের নেতৃত্বে ভোট যাওয়া তাদের ঠিক হয়নি। ফলে ভোটও শেষ ফ্রন্টও শেষ। এরপর বাকি থাকে ২০ দলীয় জোট। চলতি বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট হয়ে যায় ২০ দলীয় জোট কার্যত অচল। জোটের প্রধান দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০ দলের থাকা ছোট দলগুলো নিজেদের মতো করে নানা জোট করে। কেউ ১২ দলীয় জোট আবার কেউ জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠনে করে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত হয় আরও অনেক জোট। ইতোমধ্যে ১১টি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘নাগরিক মঞ্চ’। গত বছরের আগস্টে গঠিত হয় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। সাতটি দলের সমন্বয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ যাত্রা শুরু করলেও এ বছরের মে মাসের শুরুতে গণঅধিকার পরিষদ মঞ্চ ত্যাগ করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বছর ২০১৯ সালে এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’।
ভোটকে সামনে রেখে থেকে নেই রাজনৈতিক সমীকরণ। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে সবাই মনে করত— তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলছে। আওয়ামী লীগের অধীনে সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে ধারণা করে মানুষ। কিন্তু ভোটের মাঠে হামলার শিকার হওয়ার পর ফল বর্জন ও অন্য সিটিতে ভোট বর্জনের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে নিয়ে মানুষ নতুন কথা বলতে শুরু করেছে। এদিকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর দলটির নায়েবে আমিরে প্রকাশ্যে সাঈদীর জন্য দোয়া চাওয়া এবং দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়ার পর দলটি আসলে এখন কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। একইভাবে বিএনপি-জমায়াতের সম্পর্ক নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। বিশেষ করে মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুর পর বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও দলটির মহাসচিব পৃথক বিবৃতি দেয়ার পর রাজনীতি নানা কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে— ভোটের সমীকরণেও অংশ এটি। কারণ, জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি কার্যকর করার পরও বিএনপি কোনো কথা বলেনি, এখন বিবৃতি দিচ্ছে, ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে বিরোধী জোটের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ মনে করছেন।