আগামী ২০ বছর পর ঢাকার তাপমাত্রা কেমন হবে— সেই পরিমাণ গাছ লাগানো দরকার
—অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান, পরিবেশবিদ
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অক্সিজেনের। এটি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো গাছপালা বা সবুজায়ন করা। কিন্তু দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে সবুজ অঞ্চল। বিশেষ করে রাজধানীতে এটি বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রতিদিনই উজাড় হচ্ছে সবুজ অঞ্চলের। অপরিকল্পিত নগরায়নকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বড় বড় স্থাপনা আর পরিকল্পনাহীন নির্মাণের ফলে সবুজ অঞ্চলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে রাজধানী। সবুজ স্বল্পতায় হুমকির মধ্যে পড়ছে পরিবেশ। গাছপালা বা সবুজায়নের পরিমাণ কমে যাওয়ায় গ্রামের তুলনায় বাড়ছে তাপমাত্রা। ঢাকায় বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যান থাকলেও সঠিক পরিচর্যার অভাবে সেগুলোও প্রায় ধ্বংসের পথে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা গড়ে সাড়ে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকার উষ্ণতম স্থান এবং শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে দিন ও রাতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে সাত ও পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ৭-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পার্থক্য পৃথিবীর যে কোনো পরিমাপে ভয়ঙ্কর।
সবুজায়ন কমে যাওয়ার ফলে ঢাকার তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক তাপমাত্রায় যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে, তেমনি মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে গরম অনুভূত তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। এতে অনেক মানুষ হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে। ছায়া ছাড়া এই প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। আর বৃক্ষ ছাড়া ছায়া কখনো কল্পনা করা যায় না। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় কমে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণও। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকায় বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম। বর্ষা মৌসুমেও পরিমাণমত বৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মোট আয়তন প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার। ঢাকা সিটির মোট আয়তনের শতকরা ২০ শতাংশ এলাকা সবুজায়ন থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র সাত শতাংশেরও কম। ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ঢাকা নগর অঞ্চলের সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার থেকে হ্রাস পেয়ে ২৯ দশমিক ৮৫বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে, যা একটি শহরের জন্য ক্ষতির কারণ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় সবুজায়ন এলাকার পরিমাণ মোট আয়তনের ৯ দশমিক দুই শতাংশ। গাছপালা থাকা এলাকার হিসাব করলে এটি আরও অনেক কম হবে। শহরটির মোট আয়তনের মধ্যে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশই কংক্রিট আচ্ছাদিত। বাকি এলাকার মধ্যে ৯ দশমিক দুই শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত, চার দশমিক ৬১ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান এবং চার দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাভূমি।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে ঢাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ছিল ৮৭ দশমিক ৯ বর্গকিলোমিটার। ওই সময় রাজধানীর আয়তনের ৬৪ শতাংশে ছিল পাকা স্থাপনা। এক দশক পর কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৬ দশমিক ৩৩ বর্গকিলোমিটার বেড়ে হয় ১০৩ দশমিক ৪২ বর্গকিলোমিটার, যা বর্তমানে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। একের পর এক দালান নির্মাণের ফলে সবুজ অঞ্চল উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকার সবুজায়ন নিয়ে দুই সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। পার্ক ও উদ্যানগুলোতে সঠিক পরিচর্যার জন্য প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী কাজ কতটুকু হচ্ছে, তা সবারই প্রশ্ন। পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা না থাকায় সবুজ অঞ্চলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সবুজায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, আমরা এখন অনেক বেশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কথা আলোচনা করছি। সম্প্রতিকালে আমাদের দেশে তাপমাত্রার পরিমাণ বেড়েছে। এটিও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ঢাকার তাপমাত্রা এত পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো সবুজায়ন কমে যাওয়া। ২৮ বছর আগে বিআইপি বলেছে, ঢাকাতে মোট আয়তনের ১৩ ভাগ সবুজ ছিল। বর্তমানে তা সাত ভাগে নেমে এসেছে। সবুজের পরিমাণ যেভাবে কমেছে, ঠিক একইভাবে তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবুজের পরিমাণ যদি আরও কমে যায়, তাহলে ঢাকা মরু অঞ্চলের তাপমাত্রায় পরিণত হবে। সাধারণত ঢাকার সব আবাসিক এলাকায় বালি দ্বারা ভরাট হচ্ছে, যা এক সময় সবুজ অঞ্চল ছিল। ভরাটের জন্য নদীর তীরবর্তী গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সেখানেও সবুজ অঞ্চল বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান আরও বলেন, ঢাকায় যেসব পার্ক আছে, সেখানে এক সময় বড় বড় বৃক্ষের সঙ্গে গুল্মজাতীয় লতা জন্মাত। এখন ঢাকার ভোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া তেমন কোথাও এগুলো দেখা যায় না। কিন্তু দিন দিন লতা ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
সবুজায়ন বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এক লাখ ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন দুই লাখ গাছ লাগনোর ঘোষণা দিয়েছে। উত্তর সিটিতে গাছ লাগানো শুরু হলেও দক্ষিণ সিটিতে এখনো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। খেয়াল রাখতে হবে যে, গাছ লাগানোর আগে তাপমাত্রা কেমন ছিল এবং গাছ লাগানোর পর তাপমাত্রা কেমন হয়েছে। দুটি বিষয় ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলে পরিবর্তনটা কতটুকু হচ্ছে, তা বের করা যাবে। পরিবেশবিদ ও ভোটানিকদের সমন্বয়ে পর্যালোচনা করে তা বের করতে হবে। আগামী ২০ বছর পর ঢাকার তাপমাত্রা কী পরিমাণ হতে পারে আর সেজন্য কী পরিমাণ গাছ লাগনো দরকার— সেটি পর্যালোচনা করে গাছ লাগাতে হবে। এলোমেলো গাছ না লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে লাগাতে হবে। এর ফলে সবুজায়নে সফল হওয়া যাবে।