কোচ যদি চান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব
—ইমরান হোসেন তুষার
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাফুফে
বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনা কতটুকু? বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলের জন্য ঠিক কতটা পাগল— এমন সব প্রশ্ন করা নেহাতই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্ব এখন জানে এ দেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি কতটা ভালোবাসা রয়েছে। এই ফুটবল উন্মাদনার জন্যই সুদূর আর্জেন্টিনাও এখন আমাদের দেশকে এক নামেই চেনে। তাইতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের গোলকিপার ইমিলিয়ানো মার্টিনেজ নিজে থেকেই এ দেশে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং বাংলাদেশে এসে ঘুরেও গেছেন।
তবে আফসোস, ভিনদেশিরা আমাদের দেশকে চেনে শুধু ফুটবলের ভক্ত হিসেবে। একবার ভাবুন তো, ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হলে সুদূর আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি নিয়ে আমরা কতই না পাগলামি করি। এই ফুটবল সমর্থনের জন্য কত মারামারি হয়, বািবতণ্ডা হয়— সবই তো অন্য দেশগুলোকে নিয়ে। আমরা তর্কে জড়াই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো দেশগুলোকে নিয়ে। কখনো কী নিজের দেশ নিয়ে তর্ক করতে পেরেছি, কিংবা পারি! কেননা ফুটবল নিয়ে তর্ক করার মতো আমাদের কিছুই নেই। আছে শুধু সাফ চ্যাম্পিয়নের তকমা। বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরোতে পারেনি, বিশ্বকাপ খেলবে কবে? এখনো পর্যন্ত একমাত্র সাফ নিয়েই পড়ে আছে বাফুফে।
গেল ফুটবল আর ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা কাদের ঘরে গেছে, তা নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালে ফুটবলে ফ্রান্স আর ক্রিকেটে ইংল্যান্ড দলকে একবার চিন্তা করুন তো। দু’দলেই একটি সাধারণ মিল রয়েছে। বিশ্বকাপজয়ী দুটি দলেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় রয়েছেন অনেক। ফ্রান্স দলের ২৩ খেলোয়াড়ের ১৫ জনই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ইংল্যান্ড দলে সংখ্যাটা সাত বা আট হবে। দু’দলেরই নামের পাশেই লেখা ‘চ্যাম্পিয়ন’। ফুটবলে এবার একটু আমাদের দেশের কথাটা চিন্তা করুন তো। বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ফুটবলার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোতে। কিন্তু বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় হিসেবে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন মাত্র দুজন। সর্বপ্রথম ডেনমার্ক প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জামাল ভূঁইয়া লাল-সবুজের দলে নাম লেখান। তারপর বাংলাদেশ দলে যোগ দেন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার তারিক কাজী। সবশেষ ভিনদেশি এলিটা কিংসলেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এবং লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন। ডেনমার্ক প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সেই জামাল এখন জাতীয় দলের অধিনায়ক। জাতীয় ফুটবল দলের বড় মুখ। শুধু তা-ই নয়, জামাল এখন বাংলাদেশ ফুটবলের পোস্টারবয়। জেমি ডে যখন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্বে ছিলেন, তখন তিনি একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাইরের দেশে যত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার আছেন, তাদের দেশে আনার চেষ্টা ও প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন জেমি ডে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই প্রক্রিয়া থেমে যায়।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় দলে কে খেলবে আর কে খেলবে না— এটা নিশ্চিত করবেন কোচ। দলের ভালো-মন্দ সবকিছুই বিবেচনা করেন হেড কোচ। খেলোয়াড়দের ব্যাপারে সবকিছু আসলে তার ওপরই নির্ভর করে।
তিনি আরও বলেন, দলের ভালোর জন্য বাফুফে সবকিছুই করবে। আমাদের যতটুকু সাধ্য রয়েছে চেষ্টা করব। তুষার বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেক খেলোয়াড়ই বিদেশে রয়েছেন। আমাদের দলের কোচ যদি মনে করেন তাদের দলের সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন, তাহলে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। বিদেশে যারা আছেন, তারা যদি খেলতে চান, আমাদের দলের কোচ যদি মনে করেন তাদের জাতীয় দলে দরকার, তাহলে অবশ্যই বাফুফে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং এ ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু শুরুতেই উদাহরণ হিসেবে টানেন মরক্কোকে। তিনি বলেন, মরক্কো যদি পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না। গেল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছে মরক্কো। তাদের দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই তো বাইরের দেশের।
চুন্নু বলেন, এ কাজটি তো বাফুফের। ফেডারেশনের উচিত, আমাদের দেশের কারা কারা বিদেশে ভালো ভালো ক্লাবে খেলছে, তাদের খুঁজে নেয়া।
তিনি আরও বলেন, এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের দেশের জন্য কাজ করতে হবে। এসব খেলোয়াড়কে দেশে এনে ট্রেনিংয়ের আওতায় আনলে দেশের ফুটবলের অবস্থা আরও অনেক ভালো হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের আরেক সাবেক ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যেসব ফুটবলার বিদেশে ভালো ভালো ক্লাবে খেলছে, প্রথমত তাদের আগ্রহ থাকতে হবে। তবে আমি জানি, তাদের অনেকেরই বাংলাদেশের হয়ে খেলার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এসব খেলোয়াড়ের আগ্রহের চেয়ে বাফুফের আগ্রহটা বেশি থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ওরা (বিদেশে যারা খেলছেন) তো প্রফেশনাল। ওদের প্রতি আমাদের আগ্রহটা বেশি থাকতেই হবে। তাহলে ওরাও আমাদের দেশের হয়ে খেলতে বেশি আগ্রহী হবে।
গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যারা আছেন, ফেডারেশনের উচিত তাদের খুঁজে খুঁজে নক করা। আমাদের তরফ থেকেই প্রথমে আগ্রহটা দেখাতে হবে। আমরা যদি তা না করি, তাহলে তারা কীভাবে আগ্রহ দেখাবে?
তিনি বলেন, খেলোয়াড়দের এনে দিতে হবে, তাহলে কোচ ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন তাদের নিয়ে। ভালো খেলোয়াড় থাকলে কোচ তখন দলটাও ভালোভাবে সাজাতে পারবেন।
একনজরে কজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার
ফরিদ আলী : ইউক্রেনে বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফরিদ আলী। বর্তমানে তিনি খেলছেন পোল্যাল্ডের ক্লাব জিকেএস জাস্টরজেবির হয়ে। এর আগে ২০১৫ সালে ইউক্রেন প্রিমিয়ার লিগে মেটালার্ফ জাপোরিজিয়া ক্লাবের হয়ে অভিষেক হয় ফরিদের। ২০১৬ সালে পোল্যান্ডের ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। এখানে তিনি খেলছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে।
জিদান মিয়া : প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ফুটবলার খেলছেন স্প্যানিশ লা-লিগায়। বর্তমানে সেখানে তিনি খেলছেন রায়ো ভায়োকানোর হয়ে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের স্পোর্টিং ইউনাইটেড সকার ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকাকে জিদান মিয়া বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রতি আলাদা ভালোবাসা অনুভব করেন তিনি।
সোমিত সোম : কানাডা প্রবাসী সোমিত সোমের ২০০৩ সালে সাউথ ওয়েস্ট ইউনাইটেডের হয়ে ফুটবলের শুরু। কানাডা জাতীয় দলের জার্সি গায়েও দুটি ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ফুটবলার। তবে নিজে থেকেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়াতে চান তিনি। এর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন সোমিত সোম। তখনই এই ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
কুইন সুলিভান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ফুটবলার। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফিলাডেলফিয়া ইউনিয়নের হয়ে খেলেন কুইন সুলিভান। বয়সভিত্তিক থেকে শুরু করে এখন তিনি এই ক্লাবের মূল দলে খেলছেন।
ম্যাক্স রহমান : সুইডেন প্রবাসী ম্যাক্স রহমানের দাদার বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। পাঁচ বছর বয়সেই সুইডেনের বিখ্যাত ক্লাবে তিনি যোগ দেন। বর্তমানে তিনি খেলছেন সুইডেনের তৃতীয় বিভাগ লিগে।
হামজা চৌধুরী : ইউরোপের মাঠ মাতানো আরও কিছু ফুটবলার আছেন যারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচনায় হামজা চৌধুরী। দেশ নিয়ে আশাবাদী হলেও ইংল্যান্ডে লেস্টারসিটির হয়ে মাঠ দাপানো এই ফুটবলার ভালোই দিন কাটাচ্ছেন সেখানে।
রিদওয়ান হান্নান : অস্ট্রেলিয়া থেকে উঠে আসা ক্যানবেরা একাডেমির হয়ে খেলা তরুণ ডিফেন্ডার রিদওয়ান হান্নান। অস্ট্রেলিয়ার এএফসি ক্লাবের হয়ে খেলছেন তিনি। অসাধারণ ক্ষিপ্রতা, ট্যাকলিং এবং মাঠের চতুর্দিকে পাস দিতে পারার সক্ষমতার কারণে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ক্রেইগ ফোস্টার তার বিষয়ে বলেছিলেন, তার গতি, টেকনিক্যাল অ্যাবিলিটি আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা যে কোনো দলের জন্য সহায়ক হবে।
রিসায়াত ইসলাম খাতন : ২০১৩ সালে জাতীয় দলের ডাকে সাড়া দিয়ে অনুশীলন করেছিলেন তিনি। ইনজুরি ছিটকে দিয়েছিল লাল-সবুজ বাহিনী থেকে। এরপর ২০১৫ সালে এসে ফের জাতীয় দলে অনুপ্রবেশ। সেবার দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু অভিষেক হয়নি তার। কী এক অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশের ফুটবলে ‘নির্বাসিত’ ফুটবলার তিনি। সেই ফুটবলারটিই হলেন রিয়াসাত ইসলাম খাতন। এখন ইউরোপের এক শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করে জ্যামাইকান শীর্ষ লিগে নাম লিখিয়েছেন।