পোস্টার-ব্যানারে সয়লাব রাজধানী

আব্দুল কাইয়ুম প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২৩, ০২:০৪ পিএম
  • পোস্টার সাঁটানোর কারণে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামফলকও আড়াল হয়ে গেছে
  • পোস্টারের জন্য ডিএনসিসি ৫২টি স্টিলের কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে

যারা লাগাচ্ছে তাদের পরিচয় লেখা থাকায় ধরাও সহজ, তবুও বিষয়টি দেখার কেউ নেই

—ড. আদিল মোহাম্মদ খান

নির্বাহী পরিচালক, বিআইপি

রাজধানী ঢাকার যে দিকেই তাকাবেন পোস্টার ও ব্যানার ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়বে না। বর্তমানে নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্টের প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেখলে মনে হবে এ যেন ভিন্ন ঢাকা। এর ফলে ঢাকার সৌন্দর্য সম্পূর্ণরূপে ঢেকে গেছে পোস্টার ও ব্যানারের আড়ালে। প্রতিটি দেয়াল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ছেয়ে আছে পোস্টারে। বিশেষ করে ঢাকার বিভিন্ন বাসা ও অফিসের দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দর্শনীয় স্থান, ফুটওভার ব্রিজ, শপিংমল, সরকারি প্রতিষ্ঠান, ট্রাফিক পুলিশ বক্স, যাত্রীছাউনি, ফ্লাইওভার ব্রিজের পিলার, মেট্রোরেলের পিলার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বিদ্যুতের তার ও হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে খুব বেশি দৃশ্যমান হয়। পোস্টার ও ব্যানার সাঁটানোর কারণে অনেক সরকারি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলকও ঢেকে যায়। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয়।

বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল, কোচিং সেন্টার, চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বিজ্ঞাপন, ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি, বাসা ভাড়াসহ ইত্যাদি প্রচারণার জন্য পোস্টারে সয়লাব রাজধানী ঢাকা। বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টার ও ব্যানার বেশি লক্ষ্য করা যায়। মাঝে মাঝে কিছু আপত্তিকর পোস্টার লক্ষ করা যায়। তাছাড়া প্লাস্টিক জাতীয় পোস্টার ও ব্যানারের ফলে সামাজিক ভারসাম্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। রাজধানীর কলাবাগানের বাসার মালিক বশির ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সংবাদকে বলেন, আমার বাসার দেয়ালে বেশি পোস্টার লাগানো হতো। এটা ঠেকাতে দেয়ালটি নতুন করে রঙ করে তাতে লিখে দেই ‘এখানে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। কিন্তু পরের দিন সকালেই দেখি লেখাসহ পোস্টার দিয়ে দেয়ালটি ঢেকে দিয়েছে। ফলে দেয়ালের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর ফলে রাজধানীর সৌন্দর্য যেমন বিঘ্ন হচ্ছে তেমনি ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও। ঢাকার আসল রূপ ফিরে পেতে হলে পোস্টার ও দেয়ালিকামুক্ত করতে হবে। অনেকে পোস্টারে প্লাস্টিক ব্যবহার ও পিভিসি ব্যানার টানাচ্ছে যা কখনো পচনশীল নয়। নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার মূল সড়কের পাশে থাকা বাড়িঘরের দেয়াল রং করতে পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিলেও রাস্তার পাশে সেখানে লাগানো পোস্টারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। নগরীর সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ না হওয়ায় শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২ এর ৬নং ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করলে সে এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবে। দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে এই অপরাধের জন্য সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে, অনাদায়ে অনধিক ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে এবং উক্ত সুবিধাভোগীকে তার নিজ খরচে সংশ্লিষ্ট দেয়াল লিখন বা ক্ষেত্রমত পোস্টার মুছে ফেলার বা অপসারণের জন্য আদেশ প্রদান করা যাবে।

তাছাড়া ৪নং ধারায় বলা হয়েছে, এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, পোস্টার লাগানোর জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ৫২টি স্টিলের কাঠামো তৈরি করে দেয়া হয়েছে। যে কেউ চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেগুলো বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবে। স্ট্যান্ডটি ব্যবহারের জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সাত দিনের অনুমতি দেয়া হয়। তবে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্ধারিত স্থান দেয়া হয়নি। ফলে যত্রতত্র লাগাচ্ছে পোস্টার। তবে নির্দিষ্ট স্থান থাকলেও তা মানছে না কেউ।  

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের আমার সংবাদকে বলেন, আমরা কিছু দিন পরপর বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন ও দৃষ্টিকটু পোস্টার দেখলেই অপসারণ করি। এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে পোস্টার ও ব্যানার লাগানোর জন্য কোনো জায়গা নির্ধরিত করা হয়নি। তাছাড়া নির্দিষ্ট স্থানের ব্যাপারে কোনো ধরনের পরিককল্পনা নেই। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মোহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইনে সব কিছু বিস্তারিত দেয়া আছে শহরে কোনো ধরনের পোস্টার বা ব্যানার লাগানো যাবে না। যারা লাগাবে এবং যাদের হয়ে লাগবে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। বিষয়টি দেখার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। মূল বিষয় হচ্ছে আইনের প্রয়োগটাই অনুপস্থিত। সম্পূর্ণ শহর পোস্টারময় হয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো পদক্ষেপ নেই। তাছাড়া যারা লাগাচ্ছে তাদের পরিচয় সেখানে থাকে তাই ধরাও সহজ তবুও বিষয়টি অবহেলিত। পৃথিবীর কোনো নান্দনিক শহরে পোস্টার দেখা যায় না। বর্তমানে আধুনিকতার যোগে পোস্টারের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এর চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিলে আরও বেশি কার্যকর হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। 

দৃশ্যদূষণ থেকে উত্তরণ সম্পর্কে ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে নির্ধারণ করতে হবে কোন কোন স্থানে পোস্টার লাগাতে পারবে। যেখানে লাগালে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হবে না সেখানেই দিতে হবে। যারা নির্ধারিত স্থানের বাইরে লাগাবে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আইনের শাসন না থাকলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভন না। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পোস্টার যত্রতত্র লাগানো হচ্ছে তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে শহরের সৌন্দর্য ফিরে আনা সম্ভব।