ঢাকাবাসীকে খুশি রাখতেই রাজধানীকে লোডশেডিংমুক্ত
রাখা হচ্ছে
—ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে শহর ও গ্রামে বৈষম্য করা হচ্ছে
—এম শামসুল আলম
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
জ্বালানি সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে সরকার। ফলে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে শহরে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমানো হলেও বিপর্যস্ত গ্রামীণ জনপদ। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ। বিরূপ প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। প্রতিদিন বেড়েই চলছে লোডশেডিং
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের ১ তারিখ ১৩৫ মেঘাওয়াট, ২ তারিখ ৩২৮, ৩ তারিখ ৫৭৫, ৪ তারিখ ৭০৫, ৫ তারিখ ৮২২ মেগাওয়াট ঘাটতি দেখা যায়। এদিকে বড় লোডশেডিংয়েও কমছে না বিদ্যুৎ বিলের আকার। চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের। নেত্রকোনার বাসিন্দা রোকন উদ্দিন বলেন, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। যার কারণে ছাত্রছাত্রীরা সন্ধ্যার পর বাড়িতে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছে এবং বিদ্যুৎচালিত যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্ষতি হচ্ছে। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের সমাধান হবে কবে— প্রশ্ন সাধারণ মানুষের!
সংশ্লিষ্টরা জানান, যে পরিমাণ লোডের প্রয়োজন সেই পরিমাণে আমরা লোড পাচ্ছি না। সুতরাং আরও কিছু দিন লোডশেডিং থাকবে। লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে চাহিদার অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না বিদ্যুৎ। পুরো উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ মেগাওয়াট হলেও পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ মেগাওয়াট। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চাহিদার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে লোডশেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও লোডশেডিং হচ্ছে ১২ ঘণ্টারও বেশি। রামগতি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও বেড়ে চলছে লোডশেডিং। এতে উপজেলার ৬৫ হাজার গ্রাহক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিদ্যুতের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা।
চরগাজী ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী গ্রামের মহসিন বলেন, কয়েক দিন ধরে রাতে অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। শেষ ভাগে বিদ্যুতের দেখা মিললেও সকালে আবার চলে যায়। রাতে তীব্র গরমে ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে।
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ইজিবাইকচালক ইকরাম হোসেন জানান, আমি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। লোডশেডিংয়ের কারণে অটোরিকশা চার্জ দেয়া যায় না। এতে আয় কমে গেছে। জানা যায়, সিলেটের চাতক উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) পৃথক বিদ্যুৎ লাইন রয়েছে। শহরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকার গ্রাহক বিপিডিবির আওতায়। ছাতকে বিপিডিবির বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন ১০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে আট মেগাওয়াট। অপরদিকে, উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে আট মেগাওয়াটের বিপরীতে গড়ে প্রতিদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় প্রায় পাঁচ মেগাওয়াট।
শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে গত কয়েক বছরে মফস্বলে বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার যে প্রসার ঘটেছে, তা ফিকে হতে বসেছে। থমকে দাঁড়িয়েছে হ্যাচারি ও পোলট্রি খাত। বন্ধের পথে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোগ। লোকসান দিয়ে ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং খাতের অগ্রযাত্রায় পড়েছে ছেদ; বাড়ছে বেকারত্ব। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির পালে যে দুর্বার হাওয়া লেগেছিল, তা টেকসই হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি, বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা কম থাকায় রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে তেমন লোডশেডিং হচ্ছে না। তবে এর মধ্যেও মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে দিনে গড়ে ছয় থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সুষম উন্নয়নের স্বার্থে শহরের মতো মফস্বলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিসে বলা হয়েছে, উৎপাদন-স্বল্পতায় এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তবে এ জেলার ফুলগাজীতে দিনে কমপক্ষে ১৪ ঘণ্টা ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে দিনের বেলা লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। জেলার বোয়ালখালীতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। আনোয়ারার একজন অভিযোগ করেন গত বুধবার অন্তত ১৫ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে। এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে খামারিদের মুরগি মারা যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন। মুন্সিগঞ্জের বন্দর থানার এক খামারি জানান, লোডশেডিংয়ে গত তিন মাসে তার প্রায় দেড় লাখ টাকার মুরগি মারা গেছে। বরগুনার পাথরঘাটার আবুল খায়ের জানান, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জেনারেটর ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। বিদ্যুৎ সংকটে চলতে পারছে না হ্যাচারিগুলো। ধুঁকছে কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যমুনা হ্যাচারির ব্যবস্থাপক ফিরোজ হোসেন জানান, ডিজেল ব্যবহারের কারণে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় চাহিদামতো সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। পানির অভাবে আমন ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কৃষকরা বলেছেন, বৃষ্টি না হলে বা সেচের মাধ্যমে সময়মতো ক্ষেতে পানি না দিলে চারা মরে যাবে। ব্যাহত হবে ফসল উৎপাদন। অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা চরম বিপদে পড়েছেন। উৎপাদন কমে গেছে। অনেকে কর্মচারী ছাঁটাই করেছেন। ফলে রুদ্ধ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থেকে এক উদ্যোক্তা জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকঠাক শীতের কাপড় তৈরি করা যাচ্ছে না।
তবে কারখানা না চললেও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সাদিপুরের ফখর অটোরাইস মিলের মালিক মোহাম্মদ আলী। রংপুরের মিঠাপুকুরের নর্থ বেঙ্গল জুট মিলে দিনে গড়ে তিন হাজার পিস চটের বস্তা তৈরি হতো। লোডশেডিংয়ের ধাক্কায় উৎপাদন হচ্ছে দিনে সর্বোচ্চ এক হাজার ৮০০ পিস। জুট মিলের পরিচালক নাজমুল হক বলেন, এখানে ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় গত ছয় মাসে শতাধিক কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। লোডশেডিং গ্রামগঞ্জের অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা আকবর হোসেন বলেন, চিকিৎসক এক্স-রে দেন। বিদ্যুৎ না থাকায় ১০ মিনিটের এক্স-রে করতে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। গ্রামের মানুষ এমনিতেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, ‘শতভাগ বিদ্যুতায়ন করলেও তা জ্বালানির অভাবে সেভাবে সার্ভিস দিতে পারছে না। গ্রামের মানুষ ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায় না। এতে বিরাট বৈষম্য করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রের অধিকাংশ উৎপাদন না করেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরছে। এ লোকসান কমাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে দাম। কিন্তু মানুষ বাড়তি অর্থ খরচ করেও বিদ্যুতের দেখা পাচ্ছে না।’ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘ঢাকায় লোডশেডিং হলে তা বেশি প্রচার পায়, গ্রামের কথা সেভাবে কেউ বলে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন, তার আগে রাজধানীবাসীকে খুশি রাখতেই ঢাকা লোডশেডিংমুক্ত রাখা হচ্ছে।’