বছর না যেতেই অকার্যকর ই-টিকিট

আব্দুল কাইয়ুম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:১৭ এএম
  •  রাজধানীর তিন সহস্রাধিক বাসে ই-টিকিট ব্যবস্থা আছে
  • মালিক-শ্রমিকরা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন —অভিযোগ যাত্রীদের 
  • বেশি ভাড়া নিতে দূর গন্তব্যে ই-টিকিট দেয়ার অভিযোগ 
  • মেশিন নষ্ট কিংবা রোল না থাকার অজুহাত দেখায় কন্ডাক্টররা

টিকিট বিষয়ে অনিয়ম দূর করায় ব্যবস্থা নেয়া হবে
—খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, মহাসচিব, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি

মালিকপক্ষ ই-টিকিট বাদ দিয়ে বেশি লাভের আশায় চালকদের সঙ্গে চুক্তি করে
—মোজাম্মেল হক, মহাসচিব, যাত্রীকল্যাণ সমিতি

গণপরিবহনে যাতায়াতে ভাড়া নিয়ে ভোগান্তি নতুন কিছু নয়। ভাড়া দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় যাত্রীদের। ভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়ত বাগবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। তাই যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে গত বছরের শেষের দিকে ই-টিকিট পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। শুরুর ?দিকে কিছুটা নিয়ম মেনে টিকিটের সঠিক ব্যবহার করলেও এখন আর তেমন কোনো ব্যবহার নেই। এ যেন কাগজে আছে, কাজে নেই। পরিবহন মালিকদের হিসাবে রাজধানীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাসে ই-টিকিট ব্যবস্থা চালু আছে। তবে কোনো বাসে যাত্রীদের ই-টিকিট দেয়া হয় না। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে বাসের কন্ডাক্টররা। টিকিটের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ের নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করছে না বাস কন্ডাক্টররা। 

আজিমপুর আসার জন্য রাজধানীর মিরপুর থেকে মিরপুর সুপার লিঙ্ক বাসে উঠে সাব্বির। তিনি বলেন, পরিমাণের চেয়ে আমার কাছে বেশি ভাড়া চাওয়ায় তাদের টিকিট দিতে বলি কিন্তু কন্ডাক্টর টিকিট দিতে রাজি হয়নি। বরং আরও নানান ধরনের কথা বলে। টিকিট দিলে তাদের সাথে আমাদের কোনো ধরনের তর্ক জড়াতে হতো না।

রাজধানী ঢাকার যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে কন্ডাক্টরদের হাতে দেয়া হয় টিকিটের পজ মেশিন। তবে কন্ডাক্টরের গলায় ও পকেটে মেশিন থাকা সত্ত্বেও কেন টিকিট দেয়া হচ্ছে না— জানতে চাইলে দিশারী পরিবহনের কন্ডাক্টর জানায়, টিকিটের দিন শেষ। এখন এভাবেই ভাড়া দিতে হবে। তাছাড়া তাদের মেশিন নষ্ট ও মেশিনের রুল না থাকার অজুহাত তো আছেই। অনেক সময় দেখা যায়, টিকিট দিলেও গন্তব্য ঠিক থাকে না। বাড়তি ভাড়া আদায় করতে যাত্রীকে তার গন্তব্য থেকে পরবর্তী স্টেশনের টিকিট দিয়ে দেয়। এতে করে অতিরিক্ত ৫-১০ টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে গন্তব্যে নামার সময় গন্তব্য লেখা খেয়াল না করে টিকিটের মূল্য অনুযায়ী ভাড়া দিয়ে দেয়। এতে করে যাত্রীদের ঠকিয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের পদ্ধতি তারা ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলে কন্ডাক্টরদের উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারা বলে, স্টপেজ সেখানেই (টিকিটে  যেখানে উল্লেখ থাকে) এর আগে বাস থামবে না। তাই এই ভাড়াই দিতে হবে। 

জাবের নামের এক ব্যক্তি আমার সংবাদকে বলেন, আমি পল্টন যাওয়ার জন্য সাইন্সল্যাব থেকে সাভার পরিবহনে উঠি। টিকিট অনুযায়ী দূরত্বের ভাড়া ১০ টাকা কিন্তু হেল্পার আমার কাছে ১৫ টাকা ভাড়া চায়। আমি বারবার বলার পরও সে টিকিট দেয়নি আর ভাড়াও কম নেবে না। বাধ্য হয়ে ই-টিকিট দেয়ার কথা বললেও মেশিন নষ্ট বলে কথা কাটিয়ে যায়। শুধু সাভার পরিবহন নয় ঢাকার সব বাসের অবস্থা একই। ৫৯টি পরিবহন কোম্পানি রাজধানীর বিভিন্ন রুটে তিন হাজার ৩০৭টি বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থা চালুর ফলে যাত্রীদের মাঝে স্বস্তি কাজ করলেও এখন বেশিরভাগ বাসেই টিকিট দেয়া হয় না। নিয়মিত আগের মত ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ আছে অনেকের। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার যাত্রীদের থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ বাসে টিকিট দেয়া হয় না। এর ফলে পূর্বের মতো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অভিযোগ আছে, যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী রুটে গাবতলী ৮নং পরিবহনটি শুরু থেকেই ই-টিকিটের নিয়ম না মেনেই ভাড়া আদায় করে আসছে। যাত্রীরা কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, আমরা কোনো ই-টিকিটের নিয়মে নেই। তাই আমাদের টিকিট ছাড়াই ভাড়া দিতে হবে। 

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ১২ হাজার ৫২৬টি বাস ও মিনিবাস চলাচলের অনুমোদন আছে। তবে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাস ও মিনিবাস বিভিন্ন রুটে চলে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, যাত্রীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা কাজ করছি। আবারও টিকিট ব্যবস্থাটা যেন সচল হয় সেই ব্যবস্থা করা হবে। লোক নির্দিষ্ট করে রেখেছি যারা সব সময় তদারকি করছে। আমাদের আওতায় ২০ জন কর্মী আছে যারা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে অনিয়মের বিরুদ্ধে। কেউ যদি অনিয়মে জড়িত থাকে তাদের জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাজধানীর প্রায় সব বাসেই ই-টিকিট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, এগুলোর কথা বলতে বলতে আমরাও ক্লান্ত। সরকার যদি সঠিক পর্যবেক্ষণ না করে তাহলে তো এমনটা হবেই। ই-টিকিট ব্যবস্থাটা মালিক সমিতি চালু করেছিলেন। তাদেরও সেখানে ভালো ভূমিকা থাকার দরকার ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যখন থেকে টিকিট চালু হয়েছে তখন থেকে নিয়মিত মনিটরিং করলে এই অবস্থা হতো না। সরকার থেকে ভাড়া নির্ধারিত করার নিয়মে ফিরে গেলে এটা সমাধান করা সম্ভব। সরকার থেকে নিয়ম হলো মালিক প্রতিদিন ভাড়ার ১০ শতাংশ মুনাফা পাবে। কিন্তু বাস মালিকপক্ষ নিয়ম না মেনে চালকদের সাথে চুক্তিতে কাজ করে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা মালিককে দিতে হবে। এ জন্যই মূলত টিকিটের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। সরকার যদি নিজ থেকে ই-টিকিটের জন্য কার্যকরী ভূমিকা না রাখে তাহলে কোনো দিনও তা বাস্তবায়ন ও সমস্যার সমাধান হবে না। ভাড়া নিয়ে যাতে ভোগান্তি না হয় সেজন্য মূলত ই-টিকিট চালু করা হয়েছিল।