বিএমইটিতে স্পিড মানি হাওয়া

আবদুর রহিম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩, ১১:৪৭ পিএম
  • ডিজিটালে ধীরগতি বাধার পেছনে বিএমইটির প্রসেসিং সিন্ডিকেট
  • অনলাইনে আসা ফাইলগুলো আটকে যাচ্ছে ১৫-২০ দিন পর্যন্ত
  • দালালদের খপ্পরে পড়ে ম্যানুয়ালে সেবা নেয়ার অভিযোগ
  • অনলাইন ছাড়পত্রে টাকা নাই ম্যানুয়ালে কয়েক হাজার পকেটে ঢুকে
  • ম্যানুয়ালে সার্টিফিকেট জালিয়াতির সুযোগ, ডিজিটালে সুযোগ নেই

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অসাধু কর্মকর্তাদের অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ডিজিটাল সেবা নিতে আসা বিদেশ গমনেচ্ছুরা। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএমএইটি এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো  জটিলতার অবসান হচ্ছে না। অদৃশ্য এই সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় অসংখ্য সেবাগ্রহীতা। যদিও মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটির পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে জোর দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল সেবাগ্রহীতাদের সেবার মান বাড়ানোসহ আরও স্মার্ট সেবা নিশ্চিতে। এ কারণে অনেক সেবাগ্রহীতাই এখন বাধ্য হয়ে অবশেষে আবারও সেই সিন্ডিকেট পরিচালিত দালালদের মাধ্যমে ম্যানুয়ালের দিকেই ফিরে যাচ্ছে।

তারা বলছে, সরকার এই সেক্টরের হয়রানি কমাতে অনলাইনে ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা আনলেও অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণে মাঝে মাঝে এখানেই বেশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে প্রসেসিং সিস্টেমে নিয়োজিত থাকা কর্মকর্তাদের বেশি মনোযোগ থাকায় অনলাইনে আসা ফাইলগুলো আটকে থাকছে ১৫-২০ দিন পর্যন্ত। আর ম্যানুয়ালি আসা ফাইলগুলো সাথে সাথেই অনুমোদন পাচ্ছে। যদিও সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে ‘স্পিড মানি’ হিসেবে।  বিএমইটি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, অনলাইন বা ম্যানুয়ালি সর্বোচ্চ একদিনের বেশি সময় নেয়া হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরভি ওভারসিসের এক কর্মকর্তা জানান, ইউরোপের একটি দেশে যাওয়ার জন্য ২০ দিন আগে আবেদন করেছি, ফ্লাইটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও ক্লিয়ারেন্স পাইনি। অবশেষে বিশেষ ব্যবস্থায় শেষ মুহূর্তে ফ্লাইটের দিন ছয় ঘণ্টা আগে ওই যাত্রীদের ক্লিয়ারেন্স পাই। সেক্ষেত্রে যাত্রী প্রতি তাদের গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা করে। দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে কাজ করছেন কামাল হোসেন।  রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যুক্ত থাকা কামাল হোসেন জানিয়েছেন, ‘বিএমইটির কর্মকর্তারাই এসব সিন্ডিকেটের মূল হোতা। তারা (কর্মকর্তারা) নিজেরাই কিছু লোক দিয়ে এসব করে আসছে। তাদের সাথে আমাদের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সিও জড়িত’, যারা সেই কর্মকর্তাদের দিয়ে নানা জালিয়াতি করে আসছে। এগুলো সবাই জানে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। বললেই ঝামেলা, আর আমাদের মতো ছোট এজেন্সিগুলোর ঝামেলা আরও বেশি হয়। কারণ, সবারই তো কিছু না কিছু ঝামেলা থাকে। তাহলে অন্য কোনো ঝামেলা তৈরি করে সমস্যা করবে।

বিএমইটির বহির্গমন শাখার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার হয়রানি এড়াতে ক্লিয়ারেন্স পদ্ধতিটার ডিজিটাল করেছে। শুরুতে কিছু কিছু ফাইল সময়মতোই ইনপুট হচ্ছিল, এ অবস্থায় অনলাইনে আবেদনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আবার বিলম্ব হতে থাকে। অবশেষে বাধ্য হয়েই আবার ম্যনুয়ালি ক্লিয়ারেন্সের দিকে ঝুঁকছে এজেন্সিগুলো। বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনলাইন ছাড়পত্রে অতিরিক্ত কোনো ইনকাম নেই; আর ম্যানুয়ালি প্রত্যেক ফাইল থেকে আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ কারণেই সবার ঝোঁক থাকে এজেন্সিগুলো সরাসরি ফাইল পুট আপ দিক’। 

তবে ম্যানুয়ালে অতিরিক্ত কিছু টাকা খরচ হলেও অন্তত সময়মতো পাওয়া যায়— এমন মন্তব্য করে কামাল হোসেন আরও বলেন, এখানে কিছু টাকা খরচা করেও যদি হয়রানিমুক্ত থাকা যায়, সেটা ভালো না? বিলম্বের কারণে অনেক যাত্রীর ফ্লাইট পর্যন্ত মিস হয়েছে, যার জরিমানা এজেন্সিগুলোরই দিতে হয় বলেও জানান তিনি। দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হলেও প্রতিবাদ করছে না কেউই। এমনকী সব তথ্য-উপাত্ত দিলেও নিজের নাম প্রকাশে আগ্রহী নন কোনো ভুক্তভোগীই। এ রকমই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই প্রতিবেদককে বেশ কিছু ডকুমেন্টস দিয়েছে, সঙ্গত কারণেই তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে সেখানে দেখা যাচ্ছে, গত ১৪ আগস্ট তিনজন বিদেশগামীর ফাইল অনলাইনে জমা দিয়েছে, আর সেই ফাইল এপ্রুভ হয়েছে ২০ দিন পর ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে। এভাবে গত একমাসের একটি হিসাবে দেখা যায়, গড়ে ১৬ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগেছে প্রত্যেক ফাইল অনুমোদনে। অনেকের ক্লিয়ারেন্স পেতে অপেক্ষা করতে সময় লেগেছে ২৪ দিনও। একইসাথে আরেকটা ডকুমেন্টে দেখা যায়, জাহিদ হাসান নামের এক ব্যক্তির ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে একটি ফাইল জমা দিয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর দুপুর বেলা, সেদিন বিকেলের মধ্যেই তার ছাড়পত্র মিলেছে। 

তবে এসব নিয়ে কথা বলতে বিএমইটির মহাপরিচালককে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। তার পিএর ডেস্কে ফোন দিলে জানানো হয়, ‘স্যার এখনো নতুন দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেননি। গত ৫ সেপ্টেম্বরে বিএমইটির নতুন মহাপরিচালক হিসেবে আসেন স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফ্ফর। বিএমইটির সদ্য সাবেক মহাপরিচালক শহিদুল আলম এনডিসিকে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পোস্টিং হয়েছে তাই এসব নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তবে, মন্ত্রণালয় চাইলেই নতুন কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট বন্ধ করতে পারে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।

বিএমইটির পরিচালক (প্রশাসন) কাইসার আল ফারাবি বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে না চাইলেও বহির্গমন শাখা পরিচালকের সাথে যোগাযোগের কথা বলেন। বহির্গমন শাখার পরিচালক আব্দুল হাই জানান, আমার টেবিলে যেসব ফাইল আসে, সেসব আমি সাথে সাথেই সাইন করে পাঠাই। সর্বোচ্চ একদিনের মধ্যেই তিনি ক্লিয়ারেন্স দিয়ে থাকেন উল্লেখ করে বলেন, আমাদের অন্য সেকশনে হয়তোবা ডিলে হয়, সেটা আমার নয়। বিএমইটিকে ঘিরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, দালালদের দৌরাত্ম্য এবং সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির অভিযোগ অনেক দিনের। সে অবস্থায় প্রবাসী খাতকে হয়রানি ও দালালমুক্ত করার লক্ষ্যেই ডিজিটাল সার্ভিস চালু করে কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনের পর থেকে গেল দুই বছরে অনলাইন মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বিদেশ যাওয়ার সরকারি পদক্ষেপসমূহ সম্পূর্ণ করার জন্য সময় এবং অর্থ এ দুইয়েরই সাশ্রয় হচ্ছে। অনলাইনে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন, অনলাইন প্রি ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন বুকিং বা পিডিও সেশন বুকিং এবং সার্টিফিকেশনের মতো প্রক্রিয়াগুলোতেও অভিবাসীদের সময় এবং ভ্রমণ সাশ্রয় করে তাদের অনেক উপকৃত করেছে। আগে ম্যানুয়ালি এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে সরাসরি বিএমইটিতে যেতে হতো, এতে অতিরিক্ত সময় যেমন খরচ হতো তেমনি অপচয় হতো অতিরিক্ত অর্থেরও। আর ডিজিটাইলেশনের ফলে এখন এই প্রক্রিয়াগুলো কোনো এজেন্সি বা দালালের সহযোগিতা ছাড়াই একজন বিদেশ গমনেচ্ছু নিজেই নিজের সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারছেন। 

সমপ্রতি জাল সার্টিফিকেট দিয়ে বিদেশ যাওয়া বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। অনলাইন ক্লিয়ারেন্স সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সার্টিফিকেট জালিয়াতি ঠেকানো মুশকিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অর্থের বিনিময়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই জালিয়াতির সুযোগ থাকলেও ডিজিটাল সার্টিফিকেশনে সার্টিফিকেট জালিয়াতির কোনো সুযোগ নেই। স্মার্টসেবা নিশ্চিতে এবং জালিয়াতি ঠেকাতে এরই মধ্যে অনলাইন, রেজিস্ট্রেশন, পিডিও বুকিং ও ট্রেইনিং-সার্টিফিকেট সংগ্রহ এবং অনলাইনে ভিসা ক্লিয়ারেন্সে বা কিউ আর কোডের মাধ্যমে স্মার্ট কার্ড মিলছে এখন অনলাইনে। জালিয়াতি বন্ধে ডিজিটাল সার্ভিসের এই উদ্যোগ এরই মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে সর্বমহলে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক সাজ্জাদ হোসেন সরকার আমার সংবাদকে বলেন, কিছু অভিযোগ আমাদের চোখেও পড়েছে। আসলে এর সমাধান কিংবা উত্তর আমি দিতে পারব না। আমাদের উপরের কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।