আমরা আন্দোলন করছি এ আন্দোলনের গতি আরও বাড়বে
—সেলিমা রহমান
স্থায়ী কমিটির সদস্য
দায় সরকারকে বহন করতে হবে আন্দোলনে সরকারের পতন হবে
—জয়নুল আবেদিন ফারুক, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
টানা ৫২ দিন হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়া। লিভার সিরোসিসের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন তিনি। বারবার সিসিইউতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন দেশে আর কিছুই করার নেই। এমন প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। অবশেষে আইনগত বিষয়ে বাধা রয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যাখ্যার পর বিদেশ যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যায় গতকাল। এর আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। বেঁধে দেয়া সেই সময়ের ১৫০ ঘণ্টা পার হলেও বিএনপির রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক দল ও জনমনে।
সবশেষ আদালতের বারান্দা থেকেও বাধা আসায় এখন প্রশ্ন উঠেছে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপি কী করবে? এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দলের এক উপদেষ্টা ও এক ভাইস চেয়ারম্যান ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সংবাদকে বলেন, এ প্রশ্ন আমাদের কেন করছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এদের জিজ্ঞেস করেন। ওনারা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য কী করছেন জিজ্ঞেস করেন। এই বলেই ফোন কেটে দেন...। গত পাঁচ বছরেও খালেদা জিয়ার বিষয়ে বিএনপির রাজনৈতিক ব্যর্থতায় দলের ভেতরে ক্ষোভ চলছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, দলের প্রধান নেত্রীর মুক্তি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক ভূমিকায় বিএনপি ব্যর্থ হচ্ছে। তারা এই অক্টোবরের মধ্যেই যে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন সেটা কীভাবে সফল হবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার বিষয়ে বিএনপির পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান আমার সংবাদকে বলেন, দেখুন, আমরা নিয়মতান্ত্রিক সব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি। সরকার খালেদা জিয়াকে মেরে ফেলার উদ্দেশে আটক করেছে, বন্দি রেখেছে তাই মুক্তি দিচ্ছেন না। আমরা আন্দোলন করছি, আমাদের আন্দোলনের আরও গতি বাড়বে আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালেদা জিয়ার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকের দুর্বলতা, অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন নেতাকর্মীরা। বন্দি খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে যাওয়া দলের চরম ভুল ছিল। এরপর মুক্তির বিষয়ে গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে নরম কর্মসূচি মিলাদ, দোয়া মাহফিল, মানববন্ধন ও কয়েকটি সমাবেশ করেই সময় পার করাকেও হাইকমান্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিএনপির হাইকমান্ড সরকারের প্রেসক্রিপশনে চলছে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। যেখানে বিএনপি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে সরকার পতনের এতবড় আন্দোলন কিভাবে সফল হবে। বিএনপির চলমান নেতৃত্ব দিয়ে দলের নেতাকর্মীরাই ভরসা পাচ্ছেন না। ভুঁইফোঁড় ডজনে ডজনে দল নিয়ে সকাল বিকাল বৈঠক করে দুর্বল কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি কী ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে দলের বড় অংশের কাছেই এখন অজানা।
খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে জরুরি পদক্ষেপ না নিয়ে গুলশানে অস্তিত্বহীন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এক দফা ইস্যুতে বৈঠকের পর বৈঠক করে সময়ক্ষেপণ করে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে এখন দলের ভেতরেই সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। দল-জোট সবাই মিলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারকে বাধ্য করার মতোই কর্মসূচি চাচ্ছেন সবাই। অন্যথায় খালেদা জিয়ার অঘটন ঘটে গেলে সরকারের সঙ্গে দলের হাইকমান্ডকে তৃণমূলের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ একদিন-দুদিন নয়, বছরের পর বছর সময় পেয়েও বিএনপি কর্মসূচি প্রণয়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের মহাসচিব যখন ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন আমরা মনে করেছি তখনই সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে দেবে। কিন্তু দেয়নি। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরিবার আবারও বিদেশে চিকিৎসা পেতে আবেদন করেন। কিন্তু এই সরকার আদালতের মাধ্যমে সেটিও সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে। আদালতকে ব্যবহার করে বিদেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে, যদি বেগম জিয়ার কিছু হয়ে যায় তাহলে দায়বার সরকারকে বহন করতে হবে। এখনো সময় আছে সরকার যদি মুক্তি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে দেয় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হবে ইনশাআল্লাহ।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত আসলে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে দেয়া বক্তব্যেরই বাস্তবায়ন বলে অভিযোগ করেছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী দেশনেত্রীর উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন এর তিন-চারদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন যে, বেগম জিয়াকে বিদেশে যেতে হলে প্রথমে জেলে গিয়ে আদালতে আবেদন করতে হবে। এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান শক্তি জনগণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রীতি সমাধিস্থ করে কর্তৃত্ববাদের নতুন আদর্শ, নতুন ভাবধারা ও নতুন নতুন রচিত নীতির মাধ্যমে দেশবাসীকে নির্বাক করে বন্দি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে জনগণ পথে পথে অবরোধ করবে। পচা, গলিত একদলীয় নব্য বাকশালের হিংস্র দুঃশাসনকে প্রবল গতিতে প্রতিরোধ করবে জনগণ।
আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে দেশে আইনের শাসন নেই। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ঙ্কর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারতেন এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারতেন।