তিন চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম

আগামী মাসেই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল। ফলে চলতি মাসটি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার চাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো উদ্বোধনসহ অন্যান্য ইতিবাচক দিক জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে এগোচ্ছেও। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প উদ্বোধনের তারিখও জানানো হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। সমাবেশ ও সুধী সমাবেশের মাধ্যমে সরকার জনসাধারণের কাছে তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির তথ্যচিত্র তুলে ধরবে। কিন্তু চলতি মাসের শুরুতেই বেশ কয়েকটি ঘটনায় সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। 

এমনিতেই দেশের দীর্ঘসময় ধরে ডলার সংকট চলছে, আর এরই মধ্যে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ নিম্নমুখী হচ্ছে। যা গত ৪১ মাসের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। গত এপ্রিল, মে ও জুন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ভোটের আগে এমন তথ্য সরকারের জন্য ইতিবাচক নয়। তা ছাড়া নিত্যপণ্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশনা দেয়ার পরও তা অনিয়ন্ত্রিত রয়েছে। দেশের করোনাকালীন সংকটের সময়ও এক কেজি আলুর মূল্য ছিল মানভেদে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আলুর মূল্য কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এভাবে অন্যান্য পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পর তা আর কমছে না। দ্রব্যমূল্যে মানুষ কষ্টে আছে এটি সরকারের প্রায় সব মন্ত্রী জানেন, অন্তত তিন জন মন্ত্রী মানুষের এই কষ্টের কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু বাজার অনিয়ন্ত্রিতই থাকছে। সরকারও আন্তরিকভাবে চাচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু পারছে না, আর এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল আবার বেড়েছে গ্যাসের মূল্য। অর্থাৎ মূল্য বৃদ্ধির কোনো ইচ্ছা না থাকলেও সরকার বাধ্য হচ্ছে। ভোটের আগে অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ, ‘খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, প্রবাসী আয় বাড়ানো ও নিত্যপণ্য মূল্য কমানো’— এই তিন চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার। 

সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য বলছে, গত মাসে (সেপ্টেম্বর) দেশে প্রবাসীরা ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০৯.৫০ টাকা ধরে ১৪ হাজার ৭১২ কোটি টাকা) পাঠিয়েছেন। এটি গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর পরে সেপ্টেম্বরের আগে আর কোনো মাসে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। ডলার সংকটের মধ্যে প্রবাসী আয়ের এই চিত্র দেশের জন্য ইতিবাচক নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর পথ বন্ধে সরকার পরামর্শ দিলেও সরকার তা খুব একটা আমলে নেয়নি, যার ফলে নির্বাচনের ঠিক আগে অর্থনীতির এমন নেতিবাচক তথ্যের মুখোমুখী হতে হচ্ছে সরকারকে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো এখন সরকারে জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যা গত বছরের একই মাস (সেপ্টেম্বর) থেকে ১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার কম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ের এ পরিস্থিতিতে কোনোভাবে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে— গত দুই বছরে কাজের জন্য দেশের বাইরে গেছেন ২০ লাখ কর্মী। দেশের বাইরে যখন প্রবাসী বাড়ছে, তখন রেমিট্যান্স কমছে দিনকে দিন। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। এখন হুন্ডি বন্ধ করার চ্যালেঞ্জ নিতে পারলে প্রবাসী আয়ের বর্তমান নেতিবাচক চিত্র পাল্টে যাবে। 

অক্টোবরের শুরুতে অর্থনীতির আরেক নেতিবাচক দিক দৃশ্যমান হলো। সেটি হচ্ছে— খেলাপি ঋণ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসনের অভাবে দৃশ্যমান, যার কারণে খেলাপি ঋণের এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তথ্য বলছে, গত এপ্রিল, মে ও জুন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এ বছরের জুন পর্যন্ত এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ’২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। সরকারের কড়া নির্দেশ থাকার পরও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা যায়নি; বরং বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। এই মুহূর্তে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের আরেক চ্যালেঞ্জ।

এদিকে দেশে অব্যাহত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিক হলেও পেরে উঠছে না সিন্ডিকেটের কারণে। সরকারের শীর্ষমহল থেকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাজারের গিয়ে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে, মানুষ প্রশ্ন করছে— কে বেশি শক্তিশালী, সিন্ডিকেট না সরকার? মানুষের এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তরদাতা না থাকলেও তাদের কিছু আন্দাজ অনুমান আছে। কেউ কেউ মনে করেন, সিন্ডিকেটের সঙ্গে শক্তিমান এক ধরনের দুষ্টুচক্র জড়িয়ে আছে। ফলে দ্রব্যমূল্য ইস্যুতে নির্বাচনের আগে মানুষকে ইতিবাচক ধারণায় ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। দ্রব্যমূল্যের এই পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল আবার ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকেই নতুন এ দাম কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন। ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম আবারও বাড়ানোয় মানুষের মন খারাপ, অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করছেন। নির্বাচনি মাসে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিবর্তে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক নানা কথা বলছেন। নতুন করে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৭৯ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৩৬৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল এক হাজার ২৮৪ টাকা। এর আগে, সেপ্টেম্বরে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয় ১৪৪ টাকা। আগস্টে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল এক হাজার ১৪০ টাকা। জুন মাসের চেয়ে ১৪১ টাকা বেশি দামে আগস্টে এলপিজি বিক্রি হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স বাড়াতে স্বল্পমেয়াদে কোনো উদ্যোগ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিনিময় হার নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে তা দূর করতে হবে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর হলে হুন্ডি কমবে; এতে রেমিট্যান্স বাড়তে পারে। এ ছাড়া এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন দেশে নজর দিতে হবে।’ তিনি বলেন, মধ্য এশিয়া, সিঙ্গপুরসহ উন্নত দেশে কর্মী পাঠাতে পারলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আইনি পদক্ষেপ জোরদার করা ছাড়া তেমন কিছুই করার নেই। এ ক্ষেত্রে আদালতের দীর্ঘসূত্রতা রোধে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে খেলাপিদের জামানত বাজেয়াপ্ত করতে হবে।’

দেশের অর্থনীতির এ পরিস্থিতি উন্নতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষ অতিষ্ঠ, মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে ‘মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা এবং লাগামহীন খেলাপি ঋণ এখন অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলে এমনিতেই ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ মনে করেন, ‘সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ বেশি মূল্যে বাজারে নিত্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে। এ জন্য দায়ী বাজার সিন্ডিকেট ও সরকারের ভ্রান্ত নীতি। ‘আমাদের যে করেই হোক, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও তার দক্ষ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।