ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির হোতা ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। যাদের হুমকি-ধমকিতে এখনো আতঙ্কে দিন কাটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তাদের। যদিও ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত সরকারের নিয়োগ দেয়া কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো ব্যাংক সংস্কারের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (১) নূরুন নাহার। তার হাতেই রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ১৪ বিভাগের দায়িত্ব।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে ডেপুটি গভর্নর-২ ছিলেন নূরুন নাহার। সাবেক ডেপুটি গভর্নর-১ কাজী ছাইদুর রহমানের স্থালাভিষিক্ত হন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেশাদার কর্মকর্তা, যারা বিগত ১৫ বছর নানা প্রতিবন্ধকতায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি। কারণ, মানবসম্পদ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ বিভাগ এখন নূরুন নাহারের অধীনে, যিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সুপারিশে বিশেষ সুবিধায় নিয়োগপ্রাপ্ত। তার সঙ্গে রয়েছেন সাবেক সরকারের ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক।
নূরুন নাহার ডেপুটি গভর্নর-১ হওয়ায় ব্যাংক সংস্কারে কোনো প্রকার মন্তব্য বা পরামর্শ দিতেও ভয় পাচ্ছেন কর্মকর্তারা। ব্যাংকের অভ্যন্তরে নূরুন নাহার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এটি এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই বদলি আতঙ্কে থাকেন ব্যাংকাররা। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। আওয়ামী সরকারের আমলে যারা ব্যাংক খাতে লুটপাট চালিয়েছে তাদের স্বস্তি দিচ্ছে ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ও ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমানের চেয়ার। অন্যদিকে অস্বস্তিতে পড়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তারা।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন। তবে ওই সময় ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ও হাবিবুর রহমানকে পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নির্দেশনা অনুযায়ী, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও মো. খুরশীদ আলম পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাসও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাছের পদত্যাগপত্র দিয়েছেন গভর্নর বরাবর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পুরো চাকরি জীবনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিভাগে দায়িত্ব পালন না করেও অভিনব কায়দায় ডেপুটি গভর্নরের পদে আসেন নূরুন নাহার। চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি যার।
১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণকারী এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ‘মাত্র ১৯ বছর বয়সে’ ১৯৮৪ সালে বিএসসি সম্পন্ন করেন। এর পাঁচ বছর পর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তার চাকরির পরীক্ষার খাতায় নাম্বার ঘষামাজার অভিযোগ থাকলেও এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। বিএসসির পর পেশাগত জীবনে আর মাত্র একটি একাডেমিক ডিগ্রি রয়েছে তার। পেছনের সারির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে অর্জিত এমবিএ ডিগ্রি।
শিক্ষা ও কর্মদক্ষতায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকায় পুরো চাকরি জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিভাগের দায়িত্ব আসেনি নূরুন নাহারের কাছে। চাকরি জীবনের ১২ বছরই কেটেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমিতে। তবে ২০২৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ‘সুদৃষ্টিতে’ ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় নূরুন নাহারের। বিশেষ আনুকূল্য লাভ করেন পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের।
এই সময়ে ডেপুটি গভর্নর পদে নূরুন নাহারের নিয়োগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় ঘটনার জন্ম দেয় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যে পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হবে সেটি খালি হওয়ার প্রায় তিন মাস আগে ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল নূরুন নাহারকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অথচ ওই পদটি খালি হয় ২০২৩ সালের ১ জুলাই। এখানেই শেষ নয়। পদে বসার ১২ দিন আগেই ২০ জুন ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নূরুন নাহারের দায়িত্ব বণ্টন হয়। ওই সময় তাকে সর্বাধিক ১৪টি বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়, যেখানে অন্য তিন জ্যেষ্ঠ ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বাধীন বিভাগের সংখ্যা ছিল ১১ থেকে ১২টি। এবারও মানবসম্পদ বিভাগ তার হাতেই থাকে। এ সময় ক্ষমতা চর্চার ‘অভূতপূর্ব নিদর্শন’ দেখান তিনি। মানবসম্পদ বিভাগে প্রভাব বিস্তার করে একপ্রকার নিজেই নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে নির্বাহী পরিচালক গ্রেড-১ হন। ২২ জুন নূরুন নাহারকে নির্বাহী পরিচালক (গ্রেড-১) পদোন্নতি দিয়ে নির্দেশ জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তালুকদারের আস্থাভাজন হয়ে ক্ষমতার দাপটের একের পর এক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ২০২৩ সালের ২ জুলাই দুপুরে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই দ্বিতীয় নারী ডেপুটি গভর্নর।
২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) দায়িত্ব পান নূরুন নাহার। ডেপুটি গভর্নর পদে আসার পরও এখন পর্যন্ত এই বিভাগ তার অধীনে রয়েছে। ব্যাংক খাতের সব বিধি-বিধান এই বিভাগ থেকে প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে ব্যাংক দখল থেকে শুরু করে ঋণের নামে অর্থ লুটপাটের ও ঋণ পুনঃতফসিলের নামে অর্থ ফেরত না দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিআরপিডি। এই বিভাগের শীর্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে এসবের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই নূরুন নাহারের সামনে, এমন বক্তব্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার।
সাম্প্রতিককালে ডলার-টাকা বিনিময় হারের পুনঃনির্ধারণের সুযোগ নিয়ে কমিশনের বিনিময়ে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ক্ষতিতে ইসলামী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই লেনদেন সম্পাদনের সময় ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের (এফআরটিএমডি) দায়িত্বে ছিলেন ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার।
এছাড়া শেখ হাসিনার সরকার পতনের চার দিন আগে বিশেষ সুবিধায় ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের ২৩শ কোটি টাকা ঋণ মওকুফের ঘটনায় হাবিবুর রহমান ও নূরুন নাহারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অস্বস্তি : ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ও হাবিবুর রহমানকে নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নূরুন নাহার এখনো অনেক কর্মকর্তাকে তাদের কাজে বাধা দিয়ে আসছেন। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ডিজি-১ প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘ইউনূস সরকার কয়দিন টেকে দেখো; তার (ইউনূসের) জন্য কেন আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লাগতে যাবে’। এই শীর্ষ কর্মকর্তা আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘কোনো প্রকার যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নির্দেশে নিয়োগ পান নূরুন নাহার। সাধারণত তিন-চারজনের নাম প্রস্তাব করে সার্চ কমিটি। সেখান থেকে একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নজিরবিহীনভাবে নূরুন নাহারের বেলায় একক নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর-১ হওয়ার সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোপনীয় সিদ্ধান্ত তার বদৌলতে আগেই জানতে পারেন লুটেরারা। আমাদের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসেন, তিনি নাকি তাদেরকে বলেছেন, ‘বেশি কাজ করার দরকার নেই, আগে দেখো পরিস্থিতি কোন দিকে যায়।’ ওই ডেপুটি গভর্নর আরও বলেছেন, ‘কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। তারা কয়েকবার বিক্ষোভ করেছে। গভর্নর বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।
গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে আওয়ামীপন্থি নীল দল। সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই বিজয়ী হয়েছেন নীল দলের প্রার্থীরা। আর আওয়ামীপন্থি প্যানেলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ নূরুন নাহার।