সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবিতে ২৮ অক্টোবর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ঘোষণা দিয়েই মাঠে নামছে জামায়াত। পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে আশ্বাস না পেয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বলা হয়— পূর্বনির্ধারিত স্থানেই সমাবেশ বাস্তবায়নে অনড় তারা। পুলিশের পক্ষপাতদুুষ্ট আচরণের দাবি তুলে দেশবাসীকে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় রাজপথে এগিয়ে আসতেও আহ্বান জানানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তাদের বেশ কিছু নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে নিহত হয়। দিনটি উপলক্ষে প্রতি বছরই রাজপথে ঝটিকা কর্মসূচি পালন করছে রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত দলটি। এবার সরকার পতনে নতুন যাত্রা হিসেবে ঢাকায় তারা প্রকাশ্যে রাজপথে অবস্থান করবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে দাবি জানাতে দলীয় সব প্রস্তুতি শেষ করেছে। সরকারের আচরণের ওপর এখন নির্ভর করছে ওই দিনের পরিস্থিতি। প্রশাসন কিংবা ক্ষমতাসীন দল যদি বাধা দেয় পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতেও জামায়াত হাল ছেড়ে দেবে না। ওই দিন থেকে রাজপথে শক্ত কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি আদায় পর্যন্ত সিরিজ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে। আর যদি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে সাংবিধানিক কোনো প্রতিষ্ঠানে অবস্থান বা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে সমাবেশের সমাপ্তি করবে।
জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, গত প্রায় তিন মাস আগে পল্টন ট্র্যাজেডিকে সামনে রেখে ২৮ অক্টোবর কর্মসূচি চূড়ান্ত করে জামায়াত। ঢাকাসহ সব বিভাগীয় অঞ্চলেও তাদের সিরিজি প্রস্তুতি মিটিং হয়েছে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই তারা ঢাকায় আসছে। কিভাবে তারা ঢাকায় আসবে, কোথায় কীভাবে অবস্থান করবে, প্রশাসনের ধরপাকড় কিভাবে মোকাবিলা করবে— এসব কৌশল আগেই বলে দেয়া হয়েছে। দলের নিষ্ক্রিয় সক্রিয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে কয়েক স্তরে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। সারা দেশ থেকে জনবল ঢাকায় আসতে কোটা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলা থেকে প্রায় ১০ হাজারের উপরে নিয়ে আসতে সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাদের টার্গেট প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোক ঢাকায় নিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে তাদের দুই লক্ষাধিক লোক ঢাকায় ঢুকে পড়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি সভা।
সুনির্দিষ্ট স্থানে যদি সমাবেশ করতে না পারে তাহলে ওই দিনই তারা ঢাকার একাংশ দখল নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কৌশলগত কারণে তারা এখনই সেটি দলীয় নেতাকর্মীদের কাছেও প্রকাশ করছে না। এক ঘণ্টার নোটিসে তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মরিয়া। দলটি মনে করছে ইতোমধ্যে তাদের যে সংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকায় ঢুকে পড়েছে তা দিয়েই তারা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সফল হবে। ক্ষমতাসীন দল যদি সামনে আসে সেই মোকাবিলাও করবে তারা। কিংবা প্রশাসন যদি বিনা উসকানিতে বাধা দেয় সেটিও তারা জবাব দেয়ার চেষ্টা করবে। তবে প্রাথমিকভাবে তারা যানবাহন জনগণের যানমালে যাতে কোনো বাধা না আসে সেদিকে তারা এবার সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখবে। তাদের উদ্দেশ্য আন্দোলন ও সরকার পতন। দলীয় অবস্থান যাতে নষ্ট না হয় আবেগপ্রবণ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে গঠন করা হয়েছে চৌকস টিম। দলটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতীতেও সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে তারা সফল হয়েছেন। এবারও তারা সফল হবেন। আন্দোলন এবং রাজপথে অবস্থান ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। কূটনৈতিক মিশন ও দেশের জনগণ জামায়াতের আন্দোলনকে সফল করবে বলে মনে করছেন তারা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে । এ সরকারের শেষ অধিবেশন ও তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত দলের ভূমিকা ও কর্মসূচি কী থাকবে তা প্রায় চূড়ান্ত। কিছু কিছু কর্মসূচি স্বল্প ঘোষণায় বাস্তবায়ন করা হবে। সব ধরনের জনশক্তিকে সেই ম্যাসেজ দেয়া হবে না। প্রথম সারির নেতারা যারা শতভাগ আনুগত্যে ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে উপযুক্ত তারাই থাকবেন। এবার আর কোনো পরিস্থিতিতেও পিছু হটবে না। আগামী ২৮ তারিখ তাদের আন্দোলন নতুন যাত্রা শুরু হবে।
গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মজিবুর রহমান বলেছেন, ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে বিএনপির লোক আখ্যা দিয়ে তার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে তিনি আন্দোলন শুরু করেছিলেন যাতে তিনি কেয়ারটেকার সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিতে না পারেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে দেশে এক ভয়াবহ অরাজকতা তৈরি করা হয়েছিল। জাতির প্রশ্ন দলীয় লোক বিবেচনায় বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? এটি শেখ হাসিনার দ্বিমুখী আচরণ। দেশবাসী মনে করে, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। মহাসমাবেশে সুশৃঙ্খলভাবে সমবেত হয়ে এক দফা দাবি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা সমাবেশ করব পুলিশকে অবহিত করেছি। পুলিশের কাজ সহযোগিতা করা, বাধা দেয়া নয়। পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের আচরণের প্রতিবাদ জানাই। এ কয় দিন তল্লাশির নামে শত শত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি পুলিশ মহিলাদেরও হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকার সমাবেশের তিন দিন আগে সারা দেশে শিবিরের শোডাউন : এদিকে মহাসমাবেশের তিন দিন আগ থেকেই সরকারের পদত্যাগ, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণসহ সাত দফা দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে শক্তির জানান দিচ্ছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল তারা নোয়াখালী জেলা, পাবনা জেলা, বগুড়া জেলা, টাঙ্গাইল জেলা, মৌলভীবাজার জেলা, চাঁদপুর জেলা, পঞ্চগড় জেলা, ফরিদপুর জেলা, লক্ষ্মীপুর জেলা, সিরাজগঞ্জ জেলা, কুষ্টিয়া জেলা, ফেনী জেলা, কুড়িগ্রাম জেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, গাইবান্ধা জেলা— এ ছাড়াও যশোর জেলা, দিনাজপুর জেলা, সুনামগঞ্জ জেলা, ঝিনাইদহ জেলায় শোডাউন করেছে। মিছিলোত্তর সমাবেশে শিবির নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ যদি আগামীতে আবারো অবৈধ পন্থায় রাতের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, এবার আর সেই সুযোগ দেয়া হবে না। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে মোকাবিলা করা হবে।