ডলার বাজারে হরিলুট চলছে

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২৩, ১১:০২ পিএম
  • খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছে রেকর্ড ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা, দুই দিনে বেড়েছে ৮ টাকা
  • সরকারি প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ খরচ করা যাবে ১১৬ টাকা
  • সিদ্ধান্ত মানছে না কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা চায় বাফেদা
  • নির্ধারিত দাম বাস্তবায়নে পর্যবেক্ষণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক

ডলার বাজারে রীতিমতো হরিলুট চলছে। যে যার মতো করে ডলার কেনাবেচা করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত ভুলের সুযোগ নিয়ে কালোবাজারির আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। হুন্ডির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনে আমদানিকারকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা ব্যাংকগুলোর কারণে ডলার হারাচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে জড়িত বড় ব্যাংকগুলো। এ ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েছে সরকারি ব্যাংক। কারণ তারা বেশি দামে ডলার কিনতে পারছে না। ফলে রেমিট্যান্সও পাচ্ছে না। অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রথা চালুর পর থেকে বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। 

এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার রাতে সরকার ও ব্যাংকের প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ দর ১১৬ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। কিন্তু এ সিদ্ধান্তও মানেনি ব্যাংকগুলো। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সংগঠন দুটি। গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আয়োজিত এক বৈঠকে সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দেন গভর্নর। এতে অংশ নেয় এবিবি ও বাফেদার সঙ্গে জড়িত ২১টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীরা। 

বৈঠক শেষে এবিবির চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক চাইলে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্স কিনতে পারবে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত ক্রয় মূল্য ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারের আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা মিলে অতিরিক্ত সাড়ে পাঁচ টাকা যোগ হবে। কিন্তু ১১১ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। কারণ বাড়তি প্রণোদনার টাকা ব্যাংক নিজস্ব ফান্ড থেকে খরচ করবে। যারা এ নির্দেশনা ভঙ্গ করছে তাদের সাথে কথা হয়েছে। আমরা একত্রে বাজারটাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসব। আমদানিকারকরা নির্ধারিত দামে ডলার পাচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো আমদানিকারকের এ রকম অভিযোগ থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসে জানাতে হবে। অনেকেই তথ্যের বিভ্রাট ঘটাচ্ছে উল্লেখ করে সব বিষয়ে লাইন বাই লাইন লিখিত নির্দেশনা দেয়া যায় না বলেও মত দেন এবিবি চেয়ারম্যান।

বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, এবিবি ও বাফেদা তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ঠিকমতো বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিল। আমরাও জানিয়েছি সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। নির্দেশনার বাইরে কোনো ব্যাংক অথবা এক্সচেঞ্জ হাউজ ডলার কেনাবেচা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি আগের চেয়ে শক্তভাবে তদারকি করা হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু এর বেশি নয়। যদি কেউ বেশি দামে ডলার কিনেও থাকে তাহলে ১১১ টাকাতেই বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের এমন অস্থিরতার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে খোলাবাজারেও। ফলে বিদেশে চিকিৎসা, পড়ালেখা ও ভ্রমনেচ্ছুরা পড়েছেন মহাবিপাকে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ডলারের দর বৃদ্ধি পেয়েছে আট টাকা। গতকাল আগের দিনের চেয়ে সাড়ে তিন টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে রেকর্ড ১২৭ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিন বুধবারও যা ছিল ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা। এর আগে কখনো ডলারের দর এতো উঠেনি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে ১২০ টাকায় উঠেছিল ডলারের দর। 

ডলার বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ১২২ টাকার বেশি দরে ডলার কেনার বিষয়টি জানাজানির পর খোলাবাজারেও নগদ ডলারের দর দ্রুত বাড়ছে। গত সপ্তাহেও প্রতি ডলার ১১৮ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রেমিট্যান্স সংগ্রহে এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দর রয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। রপ্তানি আয় নগদায়ন হচ্ছে ১১০ টাকায়। আর বিক্রির দর নির্ধারিত আছে ১১১ টাকা। গতকাল মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার মানি এক্সচেঞ্জারগুলো জানায়, ডলারের অনেক সংকট। দুই দিনে রেট বেড়েছে সাত থেকে আট টাকা। গতকাল কোনো গ্রাহক ডলার বিক্রি করতে আসলে রেট দেয়া হয়েছে ১২৪ টাকা থেকে ১২৫ টাকা। আর যারা কিনেছে তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে প্রতি ডলার ১২৬ টকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা। আমার সংবাদের পক্ষ থেকে গ্রাহক সেজে কয়েকটি মানিচেঞ্জারে কল করা হয়, ‘এর মধ্যে ইসমাইল মানি এক্সচেঞ্জের এক কর্মকর্তা বলেন, ডলার দেয়া যাবে। তবে রেট বেশি। ১২৭ টাকা ৫০ টাকা হলে নিতে পারবেন।’ আরও দুটি মানিচেঞ্জার যথাক্রমে ১২৬ টাকা ৫০ পয়সা এবং ১২৭ টাকা দর হাঁকিয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্সে বাড়তি প্রণোদনা খুব একটা কাজে আসবে না। সংকট নিরসনে অর্থপাচার বন্ধ ও বাজারভিত্তিক দর কার্যকর করতে হবে। এ উদ্যোগের সমালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। 

প্রসঙ্গত, করোনার পর অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অর্থপাচার ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এতে করে ডলারের দর হু হু করে বেড়ে গত বছরের মাঝামাঝি ১১৪ টাকায় ওঠে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঠিক করে আসছে ব্যাংকগুলো। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শুরুতে ডলারের দর রেমিট্যান্সে ১০৮ এবং রপ্তানিতে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে উভয় ক্ষেত্রে ডলার কেনার দর অভিন্ন করা হয়। 

এদিকে ডলার বাজারের অস্থিরতার ফলে সরকারি ব্যাংকে প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান না থাকায় জরুরি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছর এরই মধ্যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছর ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।