- রাজপথে টুকুর অবস্থান বারবার প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ
- জামায়াত নিয়ে টুকুর বক্তব্য দলের নয় —বিবৃতিতে বিএনপি
- দলের দুঃসময়ে গ্রেপ্তারের ভয়ে টুকু বিদেশে পলাতক
- ভারতের ভূমিকায় টুকুর ক্ষোভ, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় খুশি
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। দুর্নীতির মামলায় ৯ বছরের কারাদণ্ড পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। প্রায় অর্ধ বছরেরও বেশি সময় তিনি আত্মগোপনে। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি বহু আগেই দেশ ছেড়েছেন। তবে কবে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন কেউ জানেন না। দলের এই কঠিন দুঃসময়ে কোনো কর্মসূচিতে নেই তিনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতারা যখন কঠিন সময়ে মাঠে থেকে রাজনৈতিক ভূমিকা রেখে কারাগারে যাচ্ছেন। আবার অনেকে জীবনবাজি রেখে সরকার পতনে রাজপথে রয়েছেন তখন টুকুর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ —বলছেন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
পলাতক থেকে তিনি হঠাৎ হঠাৎ বিস্ফোরক মন্তব্য করে সমালোচনায় আসছেন। দলের এই স্থায়ী কমিটির সদস্যের বক্তব্য নিয়ে বারবার বিব্রত হচ্ছে বিএনপি। সমপ্রতি অদৃশ্য জায়গা থেকে ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে টুকু বলেছেন, বিএনপি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল, জামায়াতের সঙ্গে জোট অতীত ইত্যাদি। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুকে তিনি এ কথা বলেছেন। তার এই বক্তব্য প্রসঙ্গে গতকাল শনিবার বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জামায়াত-বিএনপি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিএনপির বক্তব্য নয়, এটি টুকুর নিজস্ব বক্তব্য।
রিজভী বলেন, সমপ্রতি ভারতীয় একটি ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুতে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সেক্যুলারিজম (ধর্ম নিরপেক্ষতা), পলিটিক্যাল ইসলাম (রাজনৈতিক ইসলাম) সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কিত যে মতামত প্রদান করেছেন, সেসব বক্তব্য এবং মতামত একান্তই তার নিজস্ব। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিবৃতিতে বলা হয়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপির মূল ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সব ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নাম বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্যের অবস্থান সম্পর্কে জানেন না দলের অন্য নেতারাও। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে তাকে দেখা যায়নি। দলের কোনো ভূমিকায় তিনি রয়েছেন তাও অনেকের অজানা।
দ্য হিন্দুকে টুকু যা বলেছেন : দ্য হিন্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে টুকু বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে সমাবেশের দিন হাঙ্গামার পর গ্রেপ্তার অভিযানসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। টুকুর দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে যে সহিংসতার অভিযোগ আনা হচ্ছে, এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারি এজেন্সিগুলোই এগুলো করছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনা’ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনেছিলেন বলে দাবি করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, যদি শেখ হাসিনা এত আত্মবিশ্বাসীই হবেন, তাহলে কেন তিনি এখন এই দাবি মেনে নেবেন না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি অভিযোগ করে টুকু আরও জানান, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে তার দল অংশ নেবে না।
দ্য হিন্দুর হয়ে সাক্ষাৎকারটি নেন কল্লোল ভট্টাচার্য। তিনি বিএনপি নেতাকে বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিরোধীদের স্বাধীনতাবিরোধী এবং ইসলামপন্থিদের সঙ্গে জোট করার অভিযোগ করা হয়। জবাবে টুকু বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) আমাদের সম্পর্কে বহু বছর ধরে অসত্য কথা বলে আসছে। জামায়াতের সঙ্গে আসাদের নির্বাচনি ঐক্য ছিল। গণতন্ত্রে নানা সময় এই ধরনের রাজনৈতিক জোট দেখা যায়। ভারতেও বিজেপি এবং বামপন্থিদের মধ্যে কোনো কোনো পয়েন্টে ঐক্য দেখা গেছে।
বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল এবং আমরা ‘রাজনৈতিক ইসলামে’ বিশ্বাস করি না। জামায়াতের সঙ্গে সেই জোট এখন অতীত। শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন, তাকে জবাব দেয়া উচিত, তিনি এত বছর ক্ষমতায় থাকতেও কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেননি? বিএনপিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তার দল ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর ব্যবহারের বিরোধী। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ইসলামপন্থিদের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতা এও বলেন, ‘১৯৭১ সালের মতোই ভারতের বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করা উচিত। এখন বাংলাদেশের মানুষ একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত দাবি করে টুকু বলেন, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করব, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ক্ষয়ের সময় ভারত চুপ করে থাকবে না। ভারতের ভূমিকায় ক্ষোভের কথাও বলেন তিনি। বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ভারতের পক্ষ থেকে এমন কোনো মন্তব্য দেখতে পাইনি যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসাও করেন টুকু। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছে। আমরা একে স্বাগত জানাই এবং আশা করব, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলবে।
বারবার টুকুর ‘জামায়াতবিরোধী’ বক্তব্য : গত বছরের আগস্টে যখন বিএনপি ও জামায়াতের জোট ভেঙে যাওয়া নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিল, সে সময়ও টুকুর বক্তব্যের প্রতিবাদ আসে বিএনপির পক্ষ থেকে। আগস্টেই জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান একটি দলীয় আয়োজনে বলেছিলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট ভেঙে গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে যখন এ বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছিল না, তখন ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগে বিএনপির এক জনসভায় টুকু বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের অনেকের মুখে একটা বুলি হয়ে গেছে বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। আমি বলছি এখন সময় এসেছে, আওয়ামী লীগ-জামায়াত, আওয়ামী লীগ-জামায়াত বলার। জামায়াতও উর্দু, আওয়ামী লীগও উর্দু- এই মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, দুটো একসঙ্গে মিলবে ভালো। কেননা উনারা (সরকার) জামায়াতের নিবন্ধন ক্যানসেল করেন, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করেন না। তাহলে কি আমি বলব, ওনাদের (জামায়াত-আওয়ামী লীগের) পরকীয়া চলছে? পরদিন জামায়াতের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘টুকুর রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন তা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এটি কোনো রাজনীতিবিদের ভাষা হতে পারে না। তার এ বক্তব্য স্বৈরাচারী শাসনকে প্রলম্বিত করার ক্ষেত্র তৈরি করবে।’ পরে ৮ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন তাদের জোট ভেঙে দেয়া হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শরিকরা যুগপৎ আন্দোলনে যাবে। এরপর বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে গেলেও জামায়াত দূরে দূরে ছিল। তবে গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি ও জামায়াত একই কর্মসূচি দিচ্ছে।
বিএনপি জোটের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার সংবাদকে বলেন, দলের এই কঠিন সময়ে বিএনপির সব সিনিয়র নেতা রাজপথে রয়েছেন। সরকার পতনের ভূমিকা পালন করে নির্যাতিত হচ্ছেন, কারাবরণ করছেন। এমন মুহূর্তে একজন রাজনৈতিক পলাতক থাকা এটি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে যারা মাঠে থেকে ভূমিকা পালন করছেন, রাজনৈতিক কিছু প্রক্রিয়া ঘুছিয়ে আনা হচ্ছে তখন তিনি বিদেশ বসে অহেতুক প্রশ্ন তুলে বিশেষ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। রাজপথে রাজনৈতিক হিসেবে টুকুর ভূমিকা আগেও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। দলের এই দুঃসময়ে এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। টুকুকে নিয়ে বিএনপি আগেও বারবার বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। এখনো পড়তে হচ্ছে। যার কারণে দল থেকে বিবৃতি দিয়ে রাজনৈতিক সৌন্দর্য ধরে রাখা হচ্ছে।