বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। দলটির এক সময়ের অন্যতম জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে না। একমত পোষণ করছে এক সময়ের সরকারের অনুগত থাকা চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলনও। একই সঙ্গে অন্তত আরও পাঁচটি ইসলামী দলও এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে ডান-বামসহ অন্তত আরও তিনডজন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪-২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করে এবার সফল হতে পারবে না। যেকোনো সময় ভিন্ন আবহ তৈরি হতে পারে। তবে কূটনৈতিক চাপসহ সব কিছু উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ভর করে অতীতের মতো নির্বাচন করেও ফেলতে পারে। সেখানে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের যে প্রেশক্রিপসন রয়েছে সেগুলোও উপেক্ষিত হতে পারে। এমন সব হিসাব নিয়েই তারা এগোচ্ছে।
আজ জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকারবিরোধীরা এখনো বলছেন— তফসিল ঘোষণা না করে কমিশন যেন পদত্যাগ করে। অন্যথায় দেশে অজানা এক পরিবেশ তৈরি হলে তার দায় কমিশন ও সরকারের। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি মহাসমাবেশের দিন থেকে অন্তত চার মাসের আন্দোলনের জন্য বিশেষ ছক তৈরি করেছে। তার ধারাবাহিকতায় হরতাল শেষে পঞ্চম দফায় অবরোধ শুরু হয়েছে। আজ যদি তফসিল ঘোষণা করা হয় তাহলে ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো থেকে গণমিছিলসহ ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই কর্মসূচি জামায়াত, চরমোনাই, ইসলামী কয়েকটি দলসহ অন্তত তিন ডজন দল আলাদা আলাদা ব্যানারে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। একই সঙ্গে এই কর্মসূচি ঢাকার সঙ্গে সারা দেশেও থাকবে বলে ভাষ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের। তফসিল ঘোষণার পর প্রথম দফায় তারা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, এরপর গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঘেরাও শেষে টানা অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করা হবে।
বিএনপি বলছে, সরকার সংলাপসহ সব ধরনের সমঝোতার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১৮ দিন পর্যন্ত তাদের দলীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। পুলিশ ‘ক্রাইম সিন’ ঘোষণা করে কাউকে ঢুকতে দেয়নি। দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে। গায়েবি মামলা দিয়ে মৃত নেতাকর্মী, বিদেশে থাকা নেতাকর্মী, কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের নামেও মামলা দেয়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের না পেয়ে আত্মীয়-স্বজনদেরও আটক করা হচ্ছে। একদিকে সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করে একচেটিয়া নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে তফসিল ঘোষণার তোড়জোড় শুরু করেছে। আবার পর্দার আড়ালে কিছু নেতাকর্মীর মাধ্যমে বিশেষ অফারও দেয়া হচ্ছে। এবার তারা সরকারের ফাঁদে পা দেবে না, সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বিএনপির সাবেক এক মন্ত্রী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার সংবাদকে বলেন, সরকার তফসিলের আগেই বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করেছে সেখানেও সফল হয়নি। এরপর শীর্ষ নেতাদের আটক করে একটি ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে সেখানেও নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়েনি। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে নেতাকর্মীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি হতে পারে আমরা সেগুলো আগেই ধরে নিয়ে আন্দোলনের রোডম্যাপ ঠিক করেছি। আমাদের ভাবনা ছিল গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তফসিল পর্যন্ত কিছু গণতান্ত্রিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে। পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে চলে যাওয়ায় আমাদের কিছু ধাপ এগিয়ে কর্মসূচি ঠিক করতে হয়েছে। এখন তফসিল ঘোষণা হলেই চূড়ান্ত ধাপে চলে যাব। আমাদের এই ধাপ চলতে থাকবে নির্বাচন-পরবর্তী সময় পর্যন্ত। গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি নীরব থাকলেও এবার আমরা ডু ওর ডাই নীতি গ্রহণ করেছি। চার মাসের রোডম্যাপ তৈরি করেই হয়েছে। আমার ধারণা, এতো দূর যেতে হবে না। এর আগেই আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠবে। পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আন্দোলনের মধ্যে অনেক ভিন্নতা আসবে।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, এবার বিএনপি একা নয়। বিএনপির সঙ্গে শক্তিশালী দলগুলো রয়েছে। সবাই রাজপথে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে প্রস্তুত রয়েছে। কেউ পিছু হটবে না। ইতোমধ্যে যারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচিতে রয়েছে বা থাকার ঘোষণা দিয়েছে তারা ছাড়াও জাতীয় পার্টিসহ দেশের সরকারপন্থি অনেক রাজনৈতিক দলও বিএনপিকে সমর্থন করবে বলে ধারণা করছে তারা। অসমর্থিত একটি সূত্র বলছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আটক হওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী ও বিশেষ কিছু মাধ্যম মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছেন। অনেকের সাথে ফখরুলের সাক্ষাৎ হয়নি। আবার ক্ষমতাসীন দলের বড় পদবির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি কোনো সমঝোতায় রাজি হননি এবং তার দলকে এই সরকারের আমলে তার নিজের জামিন আবেদন না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের। বিএনপির আন্দোলনকে সমর্থন দেয়া রাজনৈতিক সূত্রগুলোর ভাষ্য, অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়ে পর্দার আড়ালে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। যখনই নির্দেশনা আসবে, তারা মাঠে নামবে। প্রথম দফায় যার যার অবস্থান থেকে ভিন্ন ব্যানারে থাকলেও পরিস্থিতির আলোকে এক ব্যানারে হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী বলছে, সমপ্রতি গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের পর তাদের তিন নেতা গুপ্তহত্যায় নিহত হয়েছেন। কয়েকশ নেতাকর্মী আটক হয়েছেন। তাদের দলীয় ফোরামে কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে সিরিজ বৈঠক চলছে। তারা বিএনপির নির্দেশিত হয়ে কর্মসূচি সফল করবে। এ ছাড়া আগে থেকেই কর্মসূচি ঘোষণা করে রেখেছে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন। তফসিল ঘোষণা করা হলে ইসি ঘেরাও করতে বিক্ষোভ বের করবেন তারা এ ছাড়া কঠোর কর্মসূচি দেয়ার কথাও জানাচ্ছে দলটি। এদিকে গতকাল নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা না করে তড়িঘড়ি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সমমনা ছয়টি ইসলামী দল।
নেতারা বলেন, সরকার জনগণের দাবির তোয়াক্কা না করে একতরফা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরো অবনতি হবে। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে। শক্তি প্রয়োগ করে, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, জেল-জুলুমের মাধ্যমে বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। এর মধ্য দিয়ে দেশকে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একতরফা আত্মঘাতী তফসিল ঘোষণা দেশবাসী মানবে না বলে জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী। তিনি বলেন, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সাথে সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফসিল ঘোষণা করা হলে ১৫ নভেম্বর বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল হবে। একতরফা তফসিল ঘোষণা দেশকে গৃহযুদ্ধের পথে নিয়ে যাবে। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া একটি দলের ইচ্ছা পূরণের তফসিল দেশবাসী মানবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নিয়ে সমঝোতাবিহীন তফসিল ঘোষণা করা হলে নতুন করে দেশে সংকট তৈরি হবে এবং দেশ নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।
তফসিল নাটক বন্ধ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, জনগণের দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচন করার জন্য উন্মত্ত-উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেছে সরকার। শেখ হাসিনা তার আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তফসিল দেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। আমরা কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, এই তফসিল নাটক বন্ধ করুন। আগে পদত্যাগ করুন। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ক্ষমতা দিন। এই দলদাস আওয়ামী নির্বাচন কমিশন বাতিল করুন। তারপর তফসিল। দাবি না মানলে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। এই তফসিলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।