পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় রেজাল্ট কমেছে
—ডা. দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী
সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবারের এইচএসসি পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ নম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ৭ শতাংশেরও বেশি। জিপিএ-৫ কমেছে ৮০ হাজারেরও বেশি। শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে ৩৭৭টি। একজন পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪২টি। এ বছর মেয়েদের পাসের হার ছেলেদের তুলনায় তিন দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।
গতকাল রোববার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ফলাফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, শিক্ষাসচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবসহ বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা স্ব-স্ব বোর্ডের ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, এসএসসি ও এইচএসসিতে ছেলেরা কেন মেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে। দেখা যাচ্ছে যে, এ বছর ছাত্রীদের পাসের হার একটু বেশি। এর জন্য ধন্যবাদ। কারণ সবসময় আমাদের শুনতে হয় জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির কথা। এখন তো উল্টো হচ্ছে। এবারও মানবিকের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে। পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় রেজাল্ট কমার কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফলাফলের বিস্তারিত সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। এইচএসসি ফলাফল পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০২৩ সালে এইচএসসি মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন। অর্থাৎ মোট পরীক্ষার্থীর ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেল করেছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৬৩ জন। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৮৩ হাজার ৬৮৭ কমেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। যদিও গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও এ বছরও কমেছে। গত বছর শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩৩০। এবার কমেছে ৩৭৭টি প্রতিষ্ঠান। একজন পান করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিছু কমেছে। গত বছর এ সংখ্যা ৫০টি হলেও এবার আটটি কমে ৪২টি হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের ফলাফল পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, এবার মানবিকের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছে। সবচেয়ে ভালো করেছে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। মানবিকের ছয় লাখ ৪৩ হাজার ১৩০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে চার লাখ ৫৫ হাজার ২৭৯ জন। অর্থাৎ ৭০ দশমিক ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সংখ্যা দুই লাখ ৫৫ হাজার ২২৭ জন। এর মধ্যে পাস করেছে দুই লাখ ২৪ হাজার ১৮৮ জন। মোট পাসের হার ৮৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের মোট পাসের হার ৭৭ শতাংশ।
জানা যায়, গত ১৭ আগস্ট শুরু হয়েছিল এ বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। অবশ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চট্টগ্রাম এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা ১০ দিন পর শুরু হয়েছিল। এবার পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচি অনুযায়ী একটি ছাড়া সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হয়েছে। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমার কারণ জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, গতবার পরীক্ষা সহজ ছিল। কম বিষয়, কম সময় ও কম নম্বরের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। এবার পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ জন্য পরীক্ষাটাও তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে। গত বছরের সঙ্গে এবারের ফলাফলের তুলনা করলে সেটি সঠিক হবে না। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির আগের যে পরীক্ষাগুলো হয়েছিল, সেখানে কেমন রেজাল্ট হয়েছিল সেটি দেখতে হবে। তার সঙ্গে মেলালে বোঝা যাবে।
পাসের হারে শীর্ষে বরিশাল, সবচেয়ে কম যশোর বোর্ডে:
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় সারা দেশে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। অন্যদিকে সবচেয়ে কম পরীক্ষার্থী পাস করেছে যশোর শিক্ষা বোর্ডে। এ বছর এইচএসসিতে সবচেয়ে বেশি ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে বরিশাল বোর্ডে। পাসের হারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
পাসের হারে এর পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে যথাক্রমে কুমিল্লা বোর্ড (৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ), চট্টগ্রাম বোর্ড (৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ), সিলেট বোর্ড (৭৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ)। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার এসেছে সমান। দুটি বোর্ডেই ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ করে শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে। আর পাসের হারে এ বছর সবচেয়ে শেষ স্থানে রয়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থী। এছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে রেকর্ড পাস করেছে। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে সর্বোচ্চ পাসের হার ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ। সব বোর্ড মিলিয়ে গড় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নোটিস বোর্ড, প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ও মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে এইচএসসির ফল সংগ্রহ করতে পারবে। ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এইচএসসি লিখে স্পেস দিয়ে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের প্রথম তিন অক্ষর, স্পেস দিয়ে রোল নম্বর ও স্পেস দিয়ে পরীক্ষার সাল টাইপ করে ১৬২২২ নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠাতে হবে। ফিরতি এসএমএসে ফলাফল জানানো হবে।
দেশের ৪২ প্রতিষ্ঠানে পাস করেনি কেউ, শতভাগ পাস ৯৫৩টিতে:
২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান ৪২টি। অর্থাৎ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেউই কৃতকার্য হতে পারেননি। অন্যদিকে দেশের ৯৫৩টি প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাসের গৌরব অর্জন করেছে। ২০২২ সালের তুলনায় এ বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৪২টি। এ বছর মোট ৯ হাজার ১৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। তারা দেশের মোট দুই হাজার ৬৫৭টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়। প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। গত বছর ৫০টি প্রতিষ্ঠানে কেউই পাস করতে পারেনি। তবে কমেছে শতভাগ পাসের প্রতিষ্ঠানও। গত বছর এক হাজার ৩৩০ শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। তা থেকে কমে এবার ৯৫৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪। এর মধ্যে সাধারণ ৯ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের ৭৫ দশমিক ৯০। সাধারণ এই শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডের শতকরা ৮০ দশমিক ৬৫ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার সবচেয়ে বেশি:
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে এগিয়ে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই বিভাগে ছাত্রদের পাসের হার ৮৭.৪৩ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ৮৮.২৫ শতাংশ। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভাগের পরই পাসের হারে এগিয়ে রয়েছে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ বিভাগে ছাত্রদের পাসের হার ৭৪.৩৭ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ৮০.৩৬ শতাংশ। আর মানবিক বিভাগে ছাত্রদের পাসের হার ৬৫.৬৮ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ৭৪.৭৭ শতাংশ।
এইচএসসির ফল পুনঃনিরীক্ষণ শুরু ২৭ নভেম্বর
এইচএসসি পরীক্ষার ফল পুনঃনিরীক্ষণের তারিখ ঘোষণা করেছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এ কর্মসূচি আজ সোমবার থেকে শুরু হয়ে চলবে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. আবুল বাশার জানান, শুধুমাত্র টেলিটক প্রি-পেইড মোবাইল ফোন থেকে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করা যাবে। আবেদন করতে মোবাইলের Message অপশনে গিয়ে RSC <Space> বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর <Space> রোল নম্বর <Space> বিষয় কোড লিখে Send করতে হবে ১৬২২২ নম্বরে।