এখন এক মঞ্চে আন্দোলন হবে কি-না সে জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে
—মাওলানা আবদুল হালিমসহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী
জামায়াত নিয়ে আলোচনা হয়েছে এখন সরকার পতন জরুরি, লাভ-ক্ষতি পরে হিসাব করা হবে
—সেলিমা রহমান
স্থায়ী কমিটির সদস্য বিএনপি
২৪ দিন পার হলো নির্বাচনি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার। ভোটের বাকি এক মাসেরও কম সময়। নিবন্ধিত ১৪টি রাজনৈতিক দলসহ অন্তত ৬৪টি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল দলীয় সরকারের অধীনে ভোটে যায়নি। গত ২৮ অক্টোবর থেকে টানা ৪৩ দিন তালা ঝুলছে বিএনপি কার্যালয়ে। চলছে ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধ। নির্বাচনের আগে-পরে অন্তত চার মাস এমন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। গত মাসের শুরুতে হরতাল-অবরোধে সাড়া পেলেও ধিরে ধিরে তা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বর্তমানে বিএনপির সব কর্মসূচিতে ঢাকার রাস্তায় দেখা যায় জ্যাম। ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার গাড়িও। কর্মসূচির প্রভাব নেই বললেই চলে। কাকডাকা ভোরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ধারাবাহিক ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করছেন। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলও কিছু কিছু এলাকায় ঝটিকা মিছিল করছে। আগে থেকেই গণমাধ্যমকে জানিয়ে ১০-১৫ জন মানুষ নিয়ে পল্টন প্রেস ক্লাব এলাকায় মিছিল করছে বামপন্থি দলগুলো।
এমন অবস্থায় বিএনপির তৃণমূল থেকে দাবি উঠেছে— ব্যানারসর্বস্ব দলগুলো বাদ দিয়ে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে মাঠে নামতে। রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবের চেয়েও সরকার পতনের আন্দোলনে কার্যত ভূমিকাই এখন বেশি জরুরি। নির্ভরযোগ্য নেতারা জানিয়েছেন, তৃণমূলের এমন দাবিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নেতাকর্মীরা তারেক রহমানকে জানিয়েছেন, ঢাকাতে কয়েকটি বাম দলের বিক্ষোভ দেখতে পান তারা কিন্তু তৃণমূলে তাদের কোনো অবস্থান নেই। কর্মসূচি নেই, ভূমিকাও দেখতে পান না। জামায়াতসহ ইসলামপন্থি যে দলগুলোর লোকবল রয়েছে তাদের নিয়েই নতুন কর্মসূচি প্রণয়নে মতামত দেন তারা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলের একটি জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে জামায়াতের সঙ্গে আমাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে। জামায়াতসহ যদি এক মঞ্চে কর্মসূচি ঘোষণা হয় তাহলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামকে আন্দোলনের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। অন্যথায় কর্মসূচির ফলাফল ঘরে তোলা সম্ভব নয়।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক নেতা বলেছেন, জামায়াতকে এক ব্যানারের কর্মসূচিতে নেয়া যায় কি-না, বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে যারা রয়েছে তাদের জানানো হয়েছে। এ নিয়ে দলে জোটে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ডান ঘরানার যারা রয়েছেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিতে তাদের আপত্তি নেই কিন্তু বামপন্থি যারা রয়েছেন তারা এ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। জামায়াতকে যদি এক ব্যানারে নেয়া হয় তাহলে তারা থাকবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। জামায়াতকে বাদ দিয়ে ইসলামপন্থি দলের বিকল্প হিসেবে চরমোনাই ও খেলাফত মজলিশকে যুক্ত করতেও অনেকে বলেছেন। জামায়াতকে সঙ্গে নিতে আপত্তি তোলা নেতারা বলছেন, বিএনপি এখন সফল আন্দোলনে রয়েছে। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে আন্দোলনে তাদের কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের হামলা হওয়া বহু লোক মারা যাওয়া এগুলো বিএনপির পক্ষেই রয়েছে। এখনো পর্যন্ত কূটনৈতিক আবহাওয়া বিএনপিকে ঘিরেই রয়েছে।
জামায়াতকে ছাড়াই এখন পর্যন্ত আন্দোলনে বিএনপির অবদান সবচেয়ে বেশি। গত ২৮ ও ২৯ জুলাই পর্যন্ত বিএনপির প্রায় ২৩ হাজার ২৫৬ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার রয়েছেন। মামলা হয়েছে ৯৭৩টি। আসামি ৮৬ হাজার ২৬৮ জন। আহতের সংখ্যা আট হাজার ৮৬৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। এর আগে গত পাঁচ বছরে আরও ২২ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে মিডিয়া সেল। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ৩৮টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ৬২৯ জন নেতাকর্মীকে সাজা দেয়া হয়েছে। যাদের অধিকাংশই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। সব মিলিয়ে বিএনপি এখন ভালো অবস্থায় রয়েছে। জামায়াতকে যদি এখন এক মঞ্চে যুক্ত করা হয় তাহলে দলে-জোটে কিছু বিষয়ে প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কারাগারে রয়েছেন।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চারদলীয় জোটে জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারেও ছিল। ২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াতও সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, বিএনপিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমর্থন দিয়ে তারাও ভোটে যায়নি। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বিএনপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল। সেখানে ঐক্যফ্রন্টের সব দলকে মিলিয়ে দেয়া ধানের শীষের ২৪টি আসন। আর জামায়াতকে একাই দেয়া হয় ২৫টি আসন। এ ছাড়া জামায়াত আরও চারটি স্থানে রাজনৈতিক কৌশলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। শুরু থেকেই জামায়াত বিএনপিকে অনুসরণ করে চলছে। গোপনে হোক-পর্দার আড়ালে হোক সংকট উত্তরণে জামায়াতকে সাথে নিয়েই বিএনপিকে চলতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া সমপ্রতি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যে আপিল করা হয়েছিল, তাও খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে অন্যায় রায় দিয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, আগামী ২৭ তারিখ পর্যন্ত বিএনপির হরতাল অবরোধ ধারাবাহিক চলতে থাকবে। এর ফাঁকে ফাঁকে নতুন নতুন আরও কিছু কর্মসূচি দেয়া হবে। বিশেষ করে আগামী ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এরপর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলনে নতুন কৌশল থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশে জোটগত ও এক মঞ্চে আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। জামায়াত অতীতেও এক মঞ্চের আন্দোলনে ছিল। যার সফল ইতিহাস রয়েছেন। এখন এক মঞ্চে আন্দোলন হবে কি-না সেটি আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে অবশ্যই বিএনপি জানাবেন বলে জানান তিনি।
জামায়াত সরকার পতনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বেশ কয়েকজন নেতাকে গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে খুন করা হয়েছে, অনেক নেতাহ আটক আহত বলে জানান তিনি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চে আন্দোলন হবে কি-না এখনো এ বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। কিছু আলোচনা এসেছে। এখন সরকার পতন জরুরি। লাভ-ক্ষতি পরে হিসাব হবে। আমরা চাই সবাই রাজপথে নেমে আসুক।’