আমাদের অনেক কিছু নিয়ে টান লেগে গেছে এগুলোকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে বিএনপিকে লাস্ট মিনিট আগ পর্যন্ত ভোটে নিয়ে আসা সম্ভব
—ড. নুরুল আমিন বেপারী
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাবি
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হলে তাদের বন্দি হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ছেড়ে দিতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে এখন এ ছাড়া আর সুযোগ নেই
—ড. দিলারা চৌধুরী
সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জাবি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে রহস্যময় হাওয়া তৈরি হয়েছে। নির্বাচন এক মাসের কম সময় থাকলেও এখনো দেশের বড় অংশে ভোট উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়নি। বিএনপিসহ ভোটে যায়নি অন্তত ৬৪টি রাজনৈতিক দল। সরকারবিরোধী শিবিরের পর্দার আড়ালে অজানা শঙ্কার খবর উড়ছে। রাজনীতি ও কূটনীতিক পাড়ায় পা রাখা বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য তিন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, কূটনৈতিক প্রেসক্রিপশনে বিএনপিসহ অন্যান্য সরকারবিরোধী দল আগামী ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাবে। বিশেষ করে অবরোধ থেকে তারা পিছু হটবে না। এর মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে নির্বাচনি ৩০০ আসনেও তারা কর্মসূচি দেবে। আগামী ১৭-১৮ ডিসেম্বর থেকে কর্মসূচিতে নতুনত্ব আসতে পারে। এরপর তারা জামায়াতসহ ইসলামী দল, বাম-ডান সবাইকে নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে। তবে তার আগে আত্মগোপনে থাকা নেতারা প্রকাশ্যে আসতে পারেন। আজ মানবাধিকার দিবসকে কেন্দ্র করে সারা দেশে জামায়াত-বিএনপি প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে ভাষ্য নেতাকর্মীদের।
রাজনীতিতে চোখ রাখা নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে— মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে বাণিজ্যিক খাতেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করছে সরকারবিরোধীরা। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, গার্মেন্ট ও মানবাধিকার বিষয় নিয়ে দেশে বড় চাপ তৈরি হতে পারে। ভোটের আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মেলাতে পারে অন্যান্য বন্ধু দেশ। বিএনপির এক সময়কার মন্ত্রী, দলটির এক নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার সংবাদকে বলেন, ‘সময়টি আর বেশি দূর নয়, বাংলাদেশে মানুষ অতীতের মতো দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। আগামী চার-পাঁচ মাস পরও মানুষ না খেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে। অতীতেও রাজনৈতিক কারণে দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে। সেই শঙ্কা আবারও দেখা দিয়েছে। এমন বার্তাগুলো বিরোধী শিবির ও সরকারের ঘরে পৌঁছানো হয়েছে বলে ভাষ্য তার। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪-১৮ সালের মতো এবার ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনি ট্রেন পার হতে পারবে না। অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হলে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যাবে। যার প্রতিটি ছায়া দেশের সব নাগরিকের উপরও পড়তে পারে। যে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে তা মোকাবিলা করার জন্য এখনো দুটো পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। সরকার যদি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে তিন মাস ভোট পিছিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যে পুনঃতফসিল দেয় তাহলে আগাম ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করা যাবে। না হলে বিরোধীরা সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে মাঠে নামতে পারে। অর্থনীতিতে যে ঝড় আসবে, তাতে দেশের ব্যবসায়ীরা পথে বসে যেতে পারেন। অর্থনীতিতে ক্ষতিকর দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশ পড়ে যেতে পারে। এ সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর যে সুনামি বয়ে যাবে তার হাওয়া দেশের সব সেক্টরে পড়তে পারে বলেও ধারণা তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপিকে ছাড়া আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং গ্রহণযোগ্যমূলক হবে না। আমরা অনেক অসহনীয় ইঙ্গি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের অনেক কিছু নিয়ে টান লেগে গেছে। এগুলোকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আমি এখনো মনে করি, নির্বাচনের লাস্ট মিনিট আগ পর্যন্ত বিএনপিকে ভোটে নিয়ে আসা সম্ভব। অতীতের বিএনপি আর আজকের বিএনপি অনেক পার্থক্য রয়েছে বলে আমি মনে করি। বিএনপি হয়তো এলিট শ্রেণির কাছে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির যে গ্রহণযোগ্যতা এটিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। দেশ-বিদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা যেই টানের মধ্যে পড়েছি সেটির সমাধান খুবই জরুরি। কিভাবে বিএনপিকে ভোটে নিয়ে আসা যায় তার এখনো অনেক পথ খোলা আছে। না হয় আমাদের জন্য এক বড় ঝুঁকি অপেক্ষা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলছেন, গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারবিরোধীরা ঢাকাসহ সারা দেশে বিশেষ ইঙ্গিতে কর্মসূচি পালন করেছে। সভা-সমাবেশে ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে। স্থানীয় কয়েকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সম্ভব নয়, কারচুপি হয়— এগুলো তারা প্রমাণ করেছে। যেখানে নির্বাচন কমিশন একটি মাত্র উপনির্বাচনে রক্তপাত এড়াতে পারে না, সংঘাত এড়াতে পারে না সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কিভাবে সম্ভব, তা কূটনীতিকদের আগেই চূড়ান্ত বার্তা দেয়া হয়েছে। সরকারবিরোধী শিবির মনে করছে, তাদের আন্দোলনের মধ্যেই র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে, ভিসানীতি ঘোষণার পর তা কার্যকরও শুরু হয়েছে। এবার তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আগামী ছয় থেকে সাত মাস পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। সরকার যদি বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করেও তবুও বিএনপি সুনির্দিষ্ট ছক থেকে পিছু হটবে না। তাদের ভাষ্য, বিদেশিদের চাপ অব্যাহত থাকবে। তারা কখন চূড়ান্ত আন্দোলনে এক সঙ্গে সব দলকে নিয়ে মাঠে নামবে, তার বড় ধরনের বার্তা পাবে। হাইকমান্ডের ভাষ্য— বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ টিকতে পারবে না। সরকারকে নির্বাচনের আগে-পরে বিদায় নিতে হবে।
ইতোমধ্যে বিএনপিসহ বিরোধীরা কূটনীতিকদের কয়েক দিন পর দেশের সামগ্রিক বিষয় উল্লেখ করে কূটনৈতিক চিঠি দিচ্ছে। আমার সংবাদের হাতে আসা এমন একটি চিঠিতে বিএনপি জানিয়েছে, ‘বিএনপি জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দায় চাপাতে বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। এ নিয়ে দেশের প্রথম সারির কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বিশেষ ডকুমেন্টও তুলে দেয়া হয়।’ চিঠিতে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের অগ্নিসংযোগ ও নৃশংসতা পুরোনো রাজনৈতিক নীতির অংশ। যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে ক্ষমতাসীন দল তাদের দমিয়ে রাখতে সব সময় আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে। এ সব ঘটনায় বিএনপি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।’ দেশব্যাপী চলমান ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করায় সাধারণ নাগরিক আতঙ্কিত বলেও উল্লেখ করা হয়। সরকারের কৌশলগত নীলনকশার অংশ হিসেবে ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পর পুলিশ মামলা করে। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যকে হত্যা, বোমা বিস্ফোরণ, ভাঙচুর, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই— এসব কিছুর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা এ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করেছি। ভোটে যাইনি। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের অনুগত নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণা করে পুরো দেশকে একটি অনিশ্চিত শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমন ঝড়ো হাওয়া আসবে তা মোকাবিলা করা সরকারের ক্ষমতা থাকবে না। যারা এই সরকারকে সহযোগিতা করছে, কেউ রেহাই পাবেন না বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন। ফারুক বলেন, আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী বন-জঙ্গলে যারা রাত কাটাচ্ছেন, আমাদের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। অনেকে সাজাপ্রাপ্ত। রাত হলেই হানাদার বাহিনীর মতো বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশকে বাড়ি ছিনিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এর একটা শেষ আছে, যার পরিণতি খুবই খারাপ হয়। আজ শুধু একজন মানুষ পুরো বাংলাদেশকে এমন বিপদে ফেলে দিয়েছে যা সহজে উত্তরণ খুবই কঠিন হয়ে যাবে। তবে সরকারের হাতে এখনো সময় আছে, যেহেতু এই সংসদ এখনো তার অধিনে। তাই সরকারকে বলব, এখনো সময় আছে আপনি দেশের মানুষের কথা ভাবুন...।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবর পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের আচরণের পর আমার মনে হয় না, বিএনপির এখন আর ভোটে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিএনপিকে ছাড়াই তো নির্বাচনের তফসিল হয়ে গেছে। এগুলো তো সমঝোতা ছাড়া একচেটিয়া হয়েছে। এখন বিএনপি নির্বাচনে যেতে হলে তাদের বন্দি হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ছেড়ে দিতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এরপর হয়তো আবার নতুনভাবে ভোটে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটি ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই । এখন সরকার কী এই পথে হাঁটবে। এটিই দেখার বিষয়।’