পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা কোনো নৈতিকতাই রাখলেন না
—তপন কান্তি ঘোষ
বাণিজ্য সচিব
সরবরাহ চেইন পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণাকে পুঁজি করে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে মসলা পণ্যটি। দুদিন ধরে ব্যাপক অভিযান ও জরিমানা করেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে বাণিজ্য সচিবের কণ্ঠে অসহায় সুর। ডিবি প্রধানের হুঙ্কারের প্রভাব পড়েনি বাজারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোক দেখানো অভিযান আর হাঁকডাকে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জনতার পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে সিন্ডিকেট পরিচালিত হলেও ক্ষমতার দাপটে পেরে উঠছে না সরকারি সংস্থাগুলো।
গতকাল বাজারে চড়া দামে পেঁয়াজ বিক্রি এবং সেই সঙ্গে এই পণ্যটি মজুত ও কালোবাজারি করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় মাঠে নেমেছে। গতকাল রাজধানীর মিন্টু রোডে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মলেনে সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কালোবাজারি করে, পেঁয়াজ মজুত করে এবং বেশি দামে বিক্রির পাঁয়তারা করে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব। ডিবির লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম চকবাজার ও শ্যামবাজার এলাকায় কাজ করেছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে।’ তবে তার এমন হুঙ্কার বাজারে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে দ্বিগুণ দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। এর আগে গত শনিবার দুপুর থেকেই সারা দেশে অভিযান শুরু করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সংস্থাটির মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানা আমার সংবাদকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কৃষি অধিদপ্তর ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করেছেন। কিন্তু এর কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি।
বিক্রেতারা বলছেন, যেখানে অভিযান চালানো দরকার সেখানে না গিয়ে বাজারে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে ভীতি সৃষ্টি করছে সরকারি সংস্থাগুলো। নাম প্রকাশ না করে যাত্রাবাড়ী আড়তের একজন ব্যবসায়ী আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রশাসন চাইলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাজার স্বাভাবিক করতে পারে। কিন্তু তারা সিন্ডিকেটের ক্ষমতার সঙ্গে না পেরে নিরীহ ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে। এগুলো করে বাজার ঠিক করা যাবে না।’
সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে বাণিজ্য সচিবের কণ্ঠেও ছিল অসহায় সুর। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতার নসিহত দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বাড়তি লাভের আশায় কোনো নৈতিকতাই রাখলেন না। ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করল আর দেশে এক দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেল। যিনি এক দিন আগে ১২০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করলেন, পরদিন তিনি কিভাবে সেটার দাম ২০০ টাকা রাখেন? এটা তো দায়িত্বশীল আচরণ নয়। দাম বাড়তে তো সময় লাগার কথা। নিত্যপণ্যের সংকট তৈরি হলেই অনেক ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়ে থাকেন।
এমন পরিস্থিতিতে বেড়েই চলছে পেঁয়াজের ঝাঁজ।
গতকাল বেশিরভাগ দোকানে খুচরায় আড়াইশ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। কোথাও কোথাও ২৮০ টাকায় উঠেছে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে পাইকারিতেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৪০ টাকার বেশি। রাজধানীর শ্যামবাজারে গতাকাল সকালে দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা কেজি। আগাম নতুন দেশি পেঁয়াজ এবং আমদানিকৃত পুরোনো মজুতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারে দেশি পেঁয়াজ ২০০ আর আমদানির স্টক বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা কেজি। অথচ আগের দিন থেকেই দুটি বাজারেই সরকারি সংস্থাগুলো সক্রিয় ছিল। কিন্তু তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বর্ধিত দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করেছে পাইকাররা। স্বাভাবিক কারণেই খুচরায় দাম বেড়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশের মতো এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের সর্বাধিক পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চল পাবনাতেও। দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশের বেশি পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ হয় পাবনা থেকে। দেশের বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চলের প্রতিটি পাইকারি বাজার এবং খোলা বাজারে গত সপ্তাহের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে গতকাল। প্রতিমণ নতুন পেঁয়াজ (মুড়িকাটা পেঁয়াজ) বিক্রি হয়েছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, আর গত মৌসুমের সংরক্ষণ করা পুরোনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রায় সাত হাজার টাকা মণ দরে। দুদিনের ব্যবধানে প্রতিমণে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেড়েছে। প্রশাসনের নাগালের মধ্যেই চলছে এমন রমরমা ব্যবসা।
জানা গেছে, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। আগে থেকে মজুত থাকা পর্যাপ্ত পেঁয়াজ রয়েছে গুদামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন অন্তত ১০ দিন কোনো প্রভাব পড়ার কথা ছিল না। এছাড়া ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরও আগে খোলা এলসির পেঁয়াজ দেশে আসছে। গত দুদিনে ভারত থেকে প্রায় ১৪শ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে এক দিনে ৭৪৩ টন পেঁয়াজ এসেছে বাংলাদেশে। গত শনিবার ২৭টি ট্রাকে করে এসব পেঁয়াজ স্থলবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। এদিন সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আরও ২০টি ট্রাকে মোট ৬০০ টন পেঁয়াজ দেশে আনা হয়। এছাড়া আগামী কয়েকদিনে আসবে আরও ৫২ হাজার টন পেঁয়াজ। এটি নিশ্চিত করতে ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল এচিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র।
অপরদিকে দেশে চাষ হওয়া পেঁয়াজও বাজারে আসতে শুরু করেছে। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মুড়িকাটা পেঁয়াজ ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতি বছর মুড়িকাটা পেয়াঁজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় আট লাখ টন। আর এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। এতে আরও বলা হয়, এই মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে এবং বাজারে থাকবে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এরপর মূল পেঁয়াজ আসা শুরু হবে এবং উৎপাদন হতে পারে প্রায় ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।
প্রতিবেশী দেশ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর এখন বিকল্প উৎস খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা। ভারতের পর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কাছের বিকল্প দেশ মিয়ানমার। দেশটি থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি করে বাজারজাত করা যায়। এর বাইরে রয়েছে পাকিস্তান, মিসর, চীন, নেদারল্যান্ডস। অবশ্য এসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে শুধু সমুদ্রপথেই সময় লাগে ১৩ থেকে ৩০ দিন। জানা গেছে, ভারত গত ২৯ অক্টোবর প্রতি টন পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেয়ার পর বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়। পরিমাণে বেশি না হলেও নিয়মিত পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছিল চীন ও পাকিস্তান থেকে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২৬ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত চীন ও পাকিস্তান থেকে ৮৩০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রুখতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আগামী সাত দিন পেঁয়াজ কেনা বন্ধের ডাক দিয়েছেন ক্রেতারা। ‘আগামী সাতদিন পেঁয়াজ বর্জন’ শীর্ষক ইভেন্ট খোলা হয়েছে ফেসবুকে। এ ইভেন্টে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এর সংখ্যা। ইভেন্টের চাওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘সবাই মিলে সাতদিনের জন্য পেঁয়াজ কেনা বন্ধ করি। যেহেতু এটা পচনশীল পণ্য, তাই ব্যবসায়ী এবং মজুতদাররা অটোমেটিক লাইনে চলে আসবে (সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে)।’
রপ্তানি বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা : বিবিসি বাংলার সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। মহারাষ্ট্রের নাসিকে যেখানে পেঁয়াজের সব থেকে বড় পাইকারি বাজার, সেখানকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হীরামন পরদেশী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, দুদিন আগেও কৃষকরা এক কুইন্টাল (১০০ কেজি) পেঁয়াজের দাম পেয়েছেন চার হাজার রুপি করে। অথচ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরই খরিদ মূল্য অর্ধেক কমে গেছে।
শুক্রবার কৃষকরা এক কুইন্টাল পেঁয়াজের দাম পেয়েছেন দেড় থেকে দুই হাজার রুপি। কৃষকরা ওই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছেন। শনিবার মহারাষ্ট্রের বেশিরভাগ পেঁয়াজ বাজারে প্রতিবাদ হয়েছে বাজার বন্ধ রেখে। কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা রাস্তা অবরোধ করেছেন। তারা বলছেন আগাম কোনো খবর ছাড়াই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এর ফলে কৃষক আর ব্যবসায়ী উভয়েরই বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।