রাজনীতিতে মাঝে মধ্যেই নাটকীয়তা দেখায় জাতীয় পার্টি। রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে, এমনটি নিজ দলের মধ্যেও নানা নাটকীয়তা জন্ম দিয়ে দলটি সবসময় আলোচনায় থাকে। ২০০০ সালে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐকজোট মিলে চারদলীয় জোট গঠন করে। ওই জোটবদ্ধভাবেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরশাদ জোট থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) গঠন করে চারদলীয় জোটে থেকে যান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ভোটে যায় জাতীয় পার্টি, কিন্তু মাঝপথে এসে ডিসেম্বরের প্রথম দশকে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া সিদ্ধান্ত নেয় জাপা এবং দলটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দলের মনোনীত প্রার্থীদের চিঠি দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বলেন। তিনি নিজেও প্রার্থিতা প্রত্যার করতে প্রতিনিধিদল পাঠান নির্বাচন কমিশনে। এ ছাড়া দলটির মহাসচিব রদবদল করতে গিয়ে বহু নাটকীয়তা দেখায় দলটি। এখন দ্বাদশ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি নতুন কোনো ঘটনার জন্ম দেয় কি-না, তা নিয়ে নানা কথা হাওয়ায় ভাসছে। তবে গত ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগে সভাপতির জাপা নিয়ে করা মন্তব্যে দলটি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।
নির্বাচনি মাঠে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মিত্র ও সমমনা দলগুলো নেই। ফলে যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোট হওয়ার কথা, ঠিক সেভাবে হচ্ছে না। এখন নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে যারা ভোটে আছে, তাদের মধ্যে গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেশ আলোচনায়। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত এই দলটি একসময় সরকার পরিচালনা করেছিল, কিন্তু ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয় এরশাদকে। এর পর থেকেই আর ক্ষমতার স্বাদ না পেলেও রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের এ সময়ে এসেও জাতীয় পার্টি আলোচনায়। স্বৈরশাসকের পতনের ৩৩ বছর পরও জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। গত ৩০ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। এর পর থেকেই জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোট শরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে আওয়ামী লীগ। ওই বৈঠকগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করা।
কিন্তু একাধিক বৈঠক হলেও সমঝোতা হয়নি। এদিকে গত ১১ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন। গতকাল বিভিন্ন গলমাধ্যমের প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে এমন খবর প্রকাশ পাওয়ায় এ নিয়ে রাজনীতিতে বেশ হইচই পড়ে। আবার একই দিন জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করে ভোটে না যেতে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে অনুরোধ করে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। এসব বিষয় নিয়ে গতকাল রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। পার্টির মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যাবে কি-না, নাকি ২০১৪ সালের মতো পদক্ষেপ নেবে তা নিয়েও অনেকে ভাবনায় পড়েছেন। এ নিয়ে বেশি ভাবনায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কারণ জাতীয় পার্টি ভোটে না এলে সংকট আরও বাড়ছে। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি যেকোনো পরিস্থিতিতে ভোট হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও আশা করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি কি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা জাতীয় সংসদের স্পিকারের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। ফলে জাপা নিয়ে সংশয়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। চলতি বছরের শুরুতে (৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার) জাতীয় পার্টির বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চিঠি দিয়েছিলেন।’ কিন্তু বেগম রওশন এরশাদসহ কয়েকজন নেতা এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। জাপা সেই নির্বাচনে অংশ না নিলে অসাংবিধানিক পরিস্থিতি ও সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হতো বলেও জানান চুন্নু। তিনি এও বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিল। আমাদের চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চূড়ান্ত সময়ে বললেন, নির্বাচন করবেন না এবং সারা দেশের সমস্ত প্রার্থীকে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি দেন। নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নেন।’ চুন্নু বলেন, ‘সেদিন এমন একটি অবস্থা হয়েছিল... বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। কোনো দল আসবে না। জাতীয় পার্টি যদি না আসে তাহলে বাংলাদেশে একটি অসাংবিধানিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হতো। সেই দিন বেগম রওশন এরশাদ ও আমরা কয়েকজন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি ও বিদ্রোহ করে বেগম এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করেছিলাম।’
দুজন মন্ত্রীর সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করে— জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতে পারছে না। দলটি কখন কী করে বসে সে বিষয়ে দলটির ওপর ভরসা করতে পারছে না আওয়ামী লীগ। ১১ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে শেখ হাসিনা এমন মন্তব্য করেছেন বলে বৈঠকের অংশ নেয়া দুজন মন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে এমন সংবাদ প্রকাশ করা হয়। ফলে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বৈধ প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর, সে কারণে জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত কী ধরনের পদক্ষেপে যাচ্ছে তা নিশ্চিত হতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে। জানা গেছে, আসন সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠকগুলোতে ভালো কোনো ফল আসেনি। ফলে জাপার মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভের কারণে জাপা যদি আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক কোনো পদক্ষেপে যায় সেটি জাতীয় রাজনীতিতে সংকট আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির মহাসচিবের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি জানান, একটু সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করছে, আরও বৈঠক হবে। তবে জাতীয় পার্টি নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্য (জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না) সম্পর্কে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলে তিনি গতকাল বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের বিশ্বাস করবেন কি-না, করেন কি-না, সেটি উনার (প্রধানমন্ত্রী) বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কোনো কমেন্টস নেই। গতকাল মঙ্গলবার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের চুন্নু এসব কথা বলেন।
‘জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে’-প্রধানমন্ত্রীর এমন আরেকটি মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি নির্বাচন করার জন্য আসছে। নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি আসেনি।’ জাতীয় পার্টির মহাসচিব আরও বলেন, ‘নির্বাচনে আসছি নির্বাচন করার জন্য, চলে যাওয়ার জন্য নয়। কেউ যদি বিশ্বাস না করে, সেটি তাদের বিষয়। উনাদের বিশ্বাস করেন না। আমরা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে নেই। নির্বাচন হলো সরকার পরিবর্তনের পথ। এবারের ভোটে যেহেতু বিএনপি আসেনি, অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট অনেক বেশি। সেই ভোট আমরা পাবো। এটি আশা করে নির্বাচনে এসেছি। সেই ভোটটি পেতে গেলে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ দরকার। পরিবেশ যদি হয়, তাহলে এবার আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি ইসি ও সরকারের কাছে শুধু ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছে। এটিই আমাদের মেইন দাবি। এটুকু হলেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
এদিকে গতকাল গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। ওই বৈঠকে তিনি জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট না করতে শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন। ওই বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, বৈঠকে রওশন এরশাদ বলেছেন, আমি দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পত্নী, বিরোধীদলীয় নেতা, আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আমার ও এরশাদের ছেলেকে (সাদ) তারা মনোনয়ন দেয়নি। ওই জায়গায় তিনি (জি এম কাদের) নিজে দাঁড়িয়েছেন। চেয়ারম্যান যদি বৈষম্য করেন, সাদ কী দোষ করেছে যে তাকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। এ রকম আরও অন্তত দেড়শ কর্মীকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। সুতরাং আপনি কার সঙ্গে অ্যালায়েন্স করবেন, আমার সঙ্গে করবেন না ওদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেছেন, ঠিক আছে, ব্যাপারটি নিয়ে আমরা ভাবব, আমরা দেখব। যেহেতু আপনি বলছেন, দল ভেঙে গেছে, দল যদি ভেঙে থাকে, তাহলে তো ভেঙে গেছে।
জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি-না, জানতে চাইলে রওশন বলেন, ‘এখন তো আর সময় নেই। আর কী বলবেন।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কী আলোচনা হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাননি। জানা গেছে, জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে জোট না করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়ে রওশন এরশাদ বলেন, নির্বাচনে জি এম কাদেরের সঙ্গে জোট করলে সুফল আসবে না। কারণ তার (জি এম কাদের) কর্মকাণ্ডে আমার (রওশন) সমর্থন নেই।
এদিকে জাতীয় পার্টি নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদকে মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে তিনি প্রশ্ন শোনে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
প্রসঙ্গত, এবারের নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে এমনটিই জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে নির্বাচন বর্জনে থাকা বাংলাদেশ মুসলিম লীগকে ইসি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের মধ্যে রাখলেও তারা প্রার্থী দেয়ার কথা অস্বীকার করেছে। অন্য দিকে, গতকাল গণতন্ত্রী পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে দেয় ইসি। ফলে ইসির হিসাবে বর্তমানে ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাঠে থাকল। যা বাস্তবে ২৭টি ভোটে রয়েছে।