অব্যাহত সংস্কারের শর্তে দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার অনুমোদন দিয়েছে । এ অর্থ আগামী শুক্রবার রিজার্ভে যোগ হবে। চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার শর্তে এ ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। গতকাল বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমফের কাছ থেকে ঋণ বাবদ যে পরিমাণ ডলার সহায়তা পাওয়া গেছে এর মাধ্যমে চলমান সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। তবে কিছুটা হলেও আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। কারণ অন্য দাতাগোষ্ঠী আইএমএফকে অনুসরণ করে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানিয়েছেন, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী থেকে পাওয়া কিস্তির ওপর ভর করে ডিসেম্বরে রিজার্ভে কিছুটা স্বস্তি মিলবে। তিনি বলেন, আইএফের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার শুক্রবার আসতে পারে। তা ছাড়া চলতি মাস ডিসেম্বরে এডিবির ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলারসহ অন্যান্য সোর্স থেকে আরও ১৩ কোটি ডলার আসবে। আর এসব অর্থের ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) কিছুটা বাড়বে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরে রিজার্ভে যোগ হবে ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। যদিও নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আকরু পেমেন্ট রয়েছে। সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রিজার্ভ থেকে বের হবে (পেমেন্ট হবে)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব মতে রিজার্ভ রয়েছে ২৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন হয়। সভা শেষে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার শর্তে দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ঋণ কর্মসূচিতে থাকা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে থাকা চাপ কমিয়ে আনতে চলমান আর্থিক সংস্কার অব্যাহত রাখার সুপারিশসহ একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে বলেছেন, আর্থিক খাতের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক চাপে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি, রিজার্ভ চলতি বছর শেষে ২৪ বিলিয়নের উপরে থাকবে।
এ জন্য আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার, আটশাট মুদ্রানীতি, বিনিময়হার বাজারমুখী করা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মতো পরামর্শ অপরিবর্তিত রেখেছে আইএমএফ। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সভায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে তিনটি বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, মুদ্রানীতিকে আরও আঁটোসাঁটো করা, নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি এবং বিনিময় হার বাজারমুখী করতে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একাধিক ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সামপ্রতিক বছরগুলোতে; এ বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পায়। সংস্থাটি বলেছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিকভাবে সুদহার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে নেমে আসে ও ২০২১ সালে আগস্টে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উঠে মূল্যস্ফীতি। এরপরই আমদানি সঙ্কোচনের নীতিতে চলে বাংলাদেশ। ফল স্বরূপ চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে থাকে আগের চেয়ে, অপ্রত্যাশিতভাবে আর্থিক হিসাব (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিতে পড়ে যায়, যেখানে এ হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অপর্যাপ্ত নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান চাপে পড়ে যায়। মুদ্রানীতির চলমান আঁটোসাঁটো নীতি অব্যাহত থাকা ও নিরপেক্ষ রাজস্বনীতি বহাল থাকলে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাত দশমিক ২৫ শতাংশ হবে আশা করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে আসছে, চলতি ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি ৮ ও আগামী জুন শেষে তা ৬ শতাংশে নেমে আসবে। এ জন্য মুদ্রানীতি সঙ্কোচন করে নীতি সুদহার প্রয়োজনে আরো বাড়াবে। আইএমএফ বলছে, যথা সময়ে রপ্তানি আয় প্রত্যাবসনের উপর জোর দিলে আর্থিক হিসাবে উন্নতি হবে বাংলাদেশের। রিজার্ভও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি অর্থবছর শেষে চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতার পর্যায়ে চলে যাবে। আগামী জুন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৪ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও দেখছে আইএমএফ। যদিও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে বাংলাদেশের। এমন প্রেক্ষাপটে পর্ষদের সভা শেষে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আন্তোয়েনেট সায়েহ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বৈশ্বিক একটি কঠিন চাপ বাংলাদেশের থাকার পরও ঋণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন সঠিক পথে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্ত প্রতিশ্রুতি থাকায়।’
‘ঋণ সহায়তাপুষ্ট কর্মসূচি সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করছে, সুরক্ষা দিচ্ছে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে। সামষ্টিক অর্থনীতির চলমান কাঠামো সংস্কার কার্যক্রম গতিশীল করবে সম্ভ্যাব্য প্রবৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কর্মসূচিকে।’ আন্তোয়েনেট সায়েহ আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলায় নেয়া মধ্যমেয়াদি নীতি-নির্ধারণী পদক্ষেপ চলমান রাখা উচিত। এ জন্য সতর্ক ও আঁটোসাঁটো মুদ্রানীতি, নিরপেক্ষ রাজস্বনীতি ও বাজারমুখী সহজলভ্য বিনিময়হার ঠিক করা প্রয়োজন, যা অর্থনীতির উপর থাকা চাপকে প্রশমিত করবে।’ বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়াবে মনে করে তিনি বলেন, ‘বর্ধনশীল রাজস্ব আদায় ও সরকারি খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা সামাজিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরচ জোগান দিতে পারবে। সরকারের অর্থ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; সরকারি ব্যয় ও রাজস্ব ঝুঁকি কমিয়ে আনতে।’
নির্বাহী সভায় বাংলাদেশ বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সুপারিশও করেন পরিচালকরা করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আদায়ে করনীতির বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ জোরালো করা, ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো ও আর্থিক ঝুঁকিগুলো আরো ভালোভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, এ জন্য ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পুররুদ্ধারের কৌশলে জোর দিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিচালকরা একমত হয়েছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণী ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা, কঠোর সুশাসন ও পুঁজিবাজারকে উন্নত করতে পারলে আর্থিক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উৎস সহজলভ্য হবে।
বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের অবস্থায় পৌঁছাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে যেতে সুপারিশ করে আইএমএফ বলেছে, বাণিজ্যের উদারীকরণ, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং শাসন বৃদ্ধি, শ্রমশক্তিকে উন্নত করা ও নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি আরও এফডিআই আকৃষ্ট করতে, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
তাই আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে কতটা ভূমিকা রাখবে এমন প্রশ্নের উত্তরে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ তত বেশি না। তারপরও যতি ঋণের এই কিস্তিটা পাই তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাংলাদেশের এই অর্থনেতিক সংকটের সময় আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পাওয়া ইতিবাচক হিসেবে কাজ করবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে।’ তিনি জানান, ‘বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও কিছু ঋণ পাওয়া যাবে। আইএমএফের ঋণ ছাড় তাতে সহায়তা করে। আইএমএফের মূল্যায়ন সবাই ফলো করে। আইএমএফ যখন প্রথম ঋণ দিলো তারপর কিন্তু বিশ্বব্যাংকও ঋণ দেয়। তবে বাংলাদেশ রিজার্ভসহ পুরো অর্থনীতি নিয়ে যে গভীর সংকটে আছে তা আইএমএফের এই অল্প পরিমাণ ঋণ দিয়ে কাটানো সম্ভব নয়। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কার। কিন্তু সংস্কারের বিষয়গুলো এখনো সুস্পষ্ট করা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে নির্বাচনের পরে করা হবে। নির্বাচনের আগে রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা দরকার।’