দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

নির্বাচনি নাশকতায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কা

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩, ১১:৪৭ পিএম

সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করা হয়েছে 
—আনোয়ার হোসেন, উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) 
পুলিশ সদর দপ্তর

নির্বাচনের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক বিষয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর। এর মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার অন্যতম
—ড. তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাবি

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে। এতে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অস্ত্র বিক্রেতা ও নির্বাচনে সহিংসতা চালাতে পারে এমন সব রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের তালিকা ধরে চলছে এ অভিযান। এদিকে বৈধ অস্ত্রের হিসাব থাকলেও দেশে কি পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র আছে তার সঠিক হিসাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কোনো সংস্থার কাছেই নেই। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ইতোমধ্যে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার শুরু করেছে পুলিশ, ডিবি ও র্যাব। তথ্যমতে, চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা তিন সহস্রাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আগেই কদর বাড়ে অবৈধ অস্ত্রের। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখানো, পেশিশক্তি প্রদর্শন, খুনখারাবি, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা কাজেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্রার্থীদের কেউ কেউ পেশাদার ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নির্বাচনে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। আর সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। ইতোমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও। তাদের অনুসারীরা বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় নেতাদের ছত্রছায়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গত কয়েক মাসে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে তারা বড় ধরনের ভূমিকা রাখার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অবৈধ অস্ত্রের সঠিক হিসাব না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে পারবে। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া অবৈধ অস্ত্রের প্রভাবে নিমিষেই অগণতান্ত্রিক রূপে পরিণত হতে পারে। সামপ্রতিক সময়ে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধমূলক একাধিক কর্মকাণ্ড করা হয়েছে। নিরীহ পথচারী নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্রের যেন অবৈধ ব্যবহার না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। 

এসবির ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের তথ্যমতে, গত আগস্ট পর্যন্ত করা হিসাবে দেখা গেছে, সারা দেশে লাইসেন্সধারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এগুলোর মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রাজনৈতিক ব্যক্তির নামে। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে সাত হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে আছে দুই হাজার ৫৭৮টি এবং অন্যান্য নেতাকর্মীর কাছে ৭৯টি বৈধ অস্ত্র রয়েছে। 

র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদর দপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ৬৪২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ৩১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে এক হাজার ৩৯৪, ২০২১ সালে ৮৪৬ ও ২০২০ সালে ৬৯৮টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে ৪৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৭টি বিভিন্ন ধরনের বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশও চলতি বছরে ৭৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে এক হাজার ৩৩৫টি। এর আগে এপ্রিল, মে ও জুনে উদ্ধার করা হয়েছিল এক হাজার ৪৫০টি অস্ত্র। আগের তিন মাসের তুলনায় পরের তিন মাসে ১১৫টি অস্ত্র কম উদ্ধার করা হয়েছে। অক্টোবর মাসে উদ্ধার হয়েছে এক হাজার ১৯২টি। ২০২২ সালে উদ্ধার হয়েছিল মোট পাঁচ হাজার ৮৭৯টি। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের বেশিরভাগই ঘটে ঢাকা, গাজীপুর, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায়।

গত ৭ অক্টোবর সীমান্ত পেরিয়ে রাজশাহীতে বিদেশি অস্ত্রের একটি চালানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৫। তাদের কাছ থেকে চারটি বিদেশি রিভলবার, তিনটি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগজিন, আট রাউন্ড তাজা গুলি, আটটি গুলির খোসা ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সংসদ নির্বাচনে সহিংসতার জন্য এসব অবৈধ অস্ত্র আনা হয়েছিল। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র-কারবারিরা এমনটাই জানান। এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে জারি করা এক পরিপত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করতে এবং নির্বাচনের পরিবেশ অনুকূলে রাখতে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও মাস্তানদের তালিকা করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়। 

জাতীয় নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা দেয়া নিয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়নি নির্বাচন কমিশন। তবে নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে বৈধ অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এদিকে, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের শঙ্কা করছে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। ভারতের মণিপুর রাজ্যে কয়েক মাস অস্ত্র লুট নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশে। ধারণা করা হচ্ছে, লুট হওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র সেখানকার সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে চোরাকারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে অস্ত্র আনছে। 

নির্বাচনকে ঘিরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতার শঙ্কা নেই তবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসীসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যারা ঘটাতে পারে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করতে বলা হয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, আমাদের দেশে সীমান্তে কড়া পাহাড়া আছে, আমরা নিশ্চিত সীমান্ত থেকে কোনো অস্ত্র আমাদের দেশে প্রবেশ করতে পারবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের নির্বাচনের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক বিষয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর। তার মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার অন্যতম। কিছুদিন আগেই বলা হয়েছে দেশে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করেছে। এখন দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করছে সীমান্ত দিয়ে। অথচ সীমান্তে আমাদের একটি বাহিনী কাজ করে। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে সেটি বড় প্রশ্ন। নির্বাচনকে সামনে রেখে পেশিশক্তি প্রদর্শন বা কোনো প্রার্থীকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য চুক্তি, নির্বাচনি মাঠ বা ভোটকেন্দ্র নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা, হামলা বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অবৈধ অস্ত্রের শক্তি কাজে লাগানো হয়। এসব বিষয় যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝতে পারে তখন তারা কোনো না কোনো কৌশল অবলম্বন করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারে। আর সেটা খুব কঠিন বলে মনে হয় না। যখনই প্রতিহিংসায় পরিণত হবে তখনই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হবে। এজন্য নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা দরকার।