দুর্ঘটনা হ্রাসে উন্নত সড়কের সঙ্গে যানবাহনের আধুনিকায়নও জরুরি
—মো. হাদিউজ্জামান, এআরআই, বুয়েট
টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন করে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো দরকার
—ড. মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় চলতি বছর চার হাজার ৮০৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মোটরসাইকেল আরোহীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে আসে। বিআরটিএর তথ্য মতে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে ডিসেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ২৫৮টি। এ সব দুর্ঘটনার ফলে নিহত হয়েছে চার ৮০৬ জন। পাঁচ হাজার ২৫৮টি দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সংখ্যা ছয় হাজার ৫৪ জন।
বিআরটিএর দেয়া তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩২২টি দুর্ঘটনায় ৩০৩ মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্ঘটনা হয় ৩০৮টি। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৪১৬ জন ও আহত হয় ৪১৬ জন। মার্চে ৩৮৭টি দুর্ঘটনায় ৪১৫ জন নিহত হয়েছে। এতে আহত হয় ৬৮৮জন। এপ্রিল মাসে দুর্ঘটনা ঘটে ৪৭৬টি। এর মধ্যে নিহত হয় ৪৫৯ জন, আর আহত হয় ৭০৫ জন। মে মাসে দুর্ঘটনা ঘটে ৪৮৩টি। এতে নিহতের ঘটনা ঘটে ৩৯৪ জন, আহত হয়েছে ৬৪৯ জন। জুলাইয়ে ৫৬৬টি দুর্ঘটনায় ৫৩৩ জন নিহত হয় ও আহত হয় ৯৩৪ জন। আগস্ট মাসে দুর্ঘটনা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪৫৮টি। এতে নিহত হয় ৩৭৬ জন। তাছাড়া আহত হয় ৬৫১ জন। এই সংখ্যা আরও কমে সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ৪৫৪ জন, নিহত হয় ৪১০ জন এবং আহত হয় ৬০৯ জন। অক্টোবরে দুর্ঘটনা হয়েছে ৪৩৭টি, নিহত হয়েছে ৪৭০ জন ও আহত হয় ৪৯২ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ৫৫৯টিতে দাঁড়ায়। এর মধ্যে নিহত হয় ৪৭০ জন। তাছাড়া আহত হয় ৫৮১ জন। চলতি মাস ডিসেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটে ২৪৬টি তার মধ্যে নিহত হয় ২১৫ জন এবং আহত হয় ৩২৪ জন।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৩৬৮টি। এর মধ্যে নিহত হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৫৪ জন। তাছাড়া এই দুর্ঘটনার ফলে আহত হয়েছে ৯ হাজার ৩০ জন। মোটরসাইকেল আরোহীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা যায়, সারা দেশে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ২৯৬টি। এর মধ্যে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে চার হাজার ২৯৬ জন। তাছাড়া আহত হয়েছেন সাত হাজার ৮৩২ জন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার বিশেষ একটা অংশ হলো মোটরসাইকেল আরোহী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় আরও দেখা যায়, ২০১৯ সালে দুর্ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৬৯৩টি ও নিহত হয় পাঁচ হাজার ২১১ জন ও আহত হয় সাত হাজার তিন জন। ২০২০ সালে চার হাজার ৭৩৫টি দুর্ঘটনা, পাঁচ হাজার ৩৩১ জন নিহত ও আহত হন সাত হাজার ৩৭৯ জন। ২০২১ সালে মোট পাঁচ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনা ঘটে, এতে নিহত হয় ছয় হাজার ২৮৪ জন ও আহত হয় সাত হাজার ৬৮৯ জন। ২০২২ সালে ছয় হাজার আটশ ২৯টি দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৭১৩ জন নিহত হয় এবং ১২ হাজার ৬১৫ জন আহত হয়।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনা ঘটে দুই হাজার ৮৭৪টি। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৩২ জন নিহত হয়। তাছাড়া আহত হয় চার হাজার ২৯৭ জন এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে সাত হাজার ৭২৯ জন। ২০১৯ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯৩৭ ও নিহতের সংখ্যা ছিল চার হাজার ৩৫৮ জন এবং আহত হয় সাত হাজার ২৪০ জন। ২০২০ সালে দুর্ঘটনা ছিল তিন হাজার ৬৪টি, নিহত তিন হাজার ৫৫৮ জন ও আহত হয় চার হাজার ৪৫০ জন। ২০২১ সালে মোট দুর্ঘটনা ঘটে তিন হাজার ২০৪ জন ও নিহত হয় তিন হাজার ৭৭৬ জন এবং আহত হয় চার হাজার আটজন। ২০২২ সালের তথ্যে দেখা যায়, দুর্ঘটনা ছিল তিন হাজার ৫২১টি, নিহত ছিল চার হাজার ১৬৫ জন ও আহত ছিল পাঁচ হাজার ৫৪ জন।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২১ সালে মোট ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সমপ্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অন্যদিকে সরকারের হিসাবে ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৮৪। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে নিহতদের সংখ্যা সরকারি তথ্যের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার বেশি। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের যে তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে নিহতদের তালিকা চাওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এই খাতে চলমান দুর্নীতি, চাঁদাবাজি বন্ধ করে টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। তা না হলে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা আমাদের কাছে দূরবর্তী স্বপ্নই থেকে যাবে। আমাদের দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি জরুরি। চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা। মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে সমস্যা শেষ হবে না। টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করাও জরুরি। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুর্ঘটনা কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশের দুর্ঘটনার চিত্রটা খুব বেশি পরিবর্তন দেখছি না। যে জায়গাগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোতে তেমন কোনো পরিবর্তন করা যায়নি। চালকদের প্রশিক্ষণের অভাবে দক্ষতা বাড়ছে না। এতে করে দুর্ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। বিআরটিএ দক্ষ চালক তৈরিতেও তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে ভারী যানবাহনের চালকদের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেকেলে নিয়মে চালক তৈরি হওয়ার ফলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সড়ক উন্নত হয়েছে কিন্তু যানবাহনের আধুনিকায়ন হয়নি। এখনো ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলছে রাস্তায়।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ট্রাফিক ব্যবস্থার কারণে সমস্যার সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। সড়কগুলোতে লেনভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। তাছাড়া যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন একই সাথে চলছে। সড়ককে ঝকঝকে করলেও চালককে দক্ষ করার কোনো চিন্তা কর্তৃপক্ষের নেই। ২০২০ সালে আমাদের লক্ষ্য ছিল ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমিয়ে আনবো কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। হয়তো ২০৩০ সালেও এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না। চলতি বছরে বিভিন্ন অবরোধ ও হরতালের কারণে দূরপাল্লার গাড়ি চলেনি। তবে তাতেও কমেনি দুর্ঘটনার সংখ্যা। আমাদের সব কিছুর সাথে সড়ক ব্যবস্থাপনারও উন্নতি হতে হবে। প্রতিটি সড়কে সিসিটিভি ও রাডারগান বসানো জরুরি। তাহলে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে পারবে না।