ভোটগ্রহণের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নানা ঘটনা দৃশ্যমান হচ্ছে। ভোটের মাঠে জনপ্রিয়তা ও একক আধিপত্য থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার মাধ্যমে ভোটে আসা জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে লড়ছেন তারা প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টি ২৬৫ আসনে প্রার্থী দিয়ে ভোটে অংশ নিলেও পরবর্তীতে মাত্র ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসে। ফলে বাকি আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থীদের অবস্থা যে খুবই শোচনীয় তা প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির শতাধিক প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ ঘোষণা দিয়ে আবার কেউ ঘোষণা না দিলেও আড়ালে আবডালে অবস্থান নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ২৬ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই ২৬ আসন যাতে জাতীয় পার্টি জয়ী হতে পারে সেজন্য এই প্রক্রিয়ায় গেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগকে বলে আসছিল যাতে তাদের জন্য ছেড়ে দেয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরিয়ে নেয়া হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে নিতে সম্মত হয়নি। আর সে কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ ইস্যুতে জাতীয় পার্টি অনেকটাই মনোক্ষুণ্ন। নৌকার প্রার্থী ২৬ আসন থেকে সরিয়ে নেয়া হলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ওই ২৬ আসনে নিশ্চিন্ত নয়, কারণ এই ২৬ আসনের অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন যাদের হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনা মোটেও সহজ হবে না। আর সে কারণে ২৬টি আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হলেও এই ২৬টি আসন জাতীয় পার্টি পাবে কিনা তা দলটি এখনো নিশ্চিত নয়। নির্বাচনের মাঠে খোঁজ নিয়ে এমন আভাসই মিলেছে।
আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের নির্বাচনি মাঠ থেকে তুলে নেয়ার পরও ওই ২৬ আসন নিয়ে যেখানে জাতীয় পার্টি নিশ্চিন্ত নয়, সেখানে দেশের অন্য আসনগুলোতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ার যে কোনো সম্ভাবনা নেই তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছেন। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও মাঠের অবস্থান দেখে নিশ্চিত হয়েছেন ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ও হুমকির মুখে মাঠে টিকে থাকা কঠিন। এসব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা দলে দলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
গত এক জানুয়ারি রাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন।
তিনি জানান, গত ২৭ ডিসেম্বর বুধবার থেকে তিনি নির্বাচনি সব প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত রয়েছেন। কেননা তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের টাকার পাল্লার কাছে নির্বাচন করার মতো তার অবস্থা নেই। এ ছাড়া দলের চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। ফোন দিলেও তারা ধরেন না। কেন্দ্রে যারা আছেন তারা কেউ সহযোগিতা করছেন না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জাপাকে ২৬ আসন দিয়েছে। এই ২৬ জনের থেকে জিএম কাদেরসহ অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। মাঠে এখনও যারা আছেন তারা কেউ কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। ৭ তারিখের আগ পর্যন্ত অনেকেই হয়ত ছেড়ে দিতে পারেন। নির্বাচন আমার মতো মানুষের জন্য না। ভদ্র মানুষের নির্বাচন না। নির্বাচন হচ্ছে অর্থ আর পেশিশক্তির খেলা, বলছিলেন জাপা নেতা সোহরাব হোসেন।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের দুই প্রার্থী ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তারা হলেন— দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনে মো. মাহবুব আলম ও গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সামসুদ্দিন খান। গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে তারা নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেন। দিনাজপুর-২ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মো. মাহবুব আলম প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ হিসেবে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে তার সংশয়ের কথা উল্লেখ করেন।
আর গাজীপুর-৪ আসনের প্রার্থী সামসুদ্দিন খান জানিয়েছেন, শারীরিক ও আর্থিক অক্ষমতার কারণে তিনি ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। গত কয়েক দিন ধরে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর যে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন, এদের মধ্যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো কারণ ভিন্ন ভিন্ন। তবে বেশির ভাগই নির্বাচনে নৌকার সঙ্গে পেরে উঠতে না পারার কথাই উল্লেখ করেছেন। জাপার ২৬৫ আসনের মধ্যে দেড়শতাধিক আসনের প্রার্থীরাই জামানত হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। টাকার খেলা, পেশিশক্তির প্রভাবসহ নানা অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যে শতাধিক প্রার্থী ভোটের মাঠ থেকে উধাও হয়ে গেছেন। বরিশাল-২ ও ৫ আসনের জাপা প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস এবং বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী খলিলুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে মো. শাহানুল করিম, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের জাকির হোসেনসহ আরও ১০-১২ জন নির্বাচন থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে ঘোষণা না দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছন। যারা নির্বাচনের মাঠে নেই তাদের অনেকে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা বা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদেরও জানাচ্ছেন না। আবার অনেকে জানানোর চেষ্টা করলেও নেতাদের পাচ্ছেন না।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের লাঙ্গলের প্রার্থী মুজিবুল হক চুন্নু মনে করেন, টাকা খরচের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের কেউ কেউ নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছেন। গতকাল কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামে নি?জ বা?ড়ি?তে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা কেন্দ্র থেকে জাপা প্রার্থী?দের কোনো আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছি না। এজন্যই হয়তো তাদের হতাশা আছে এবং হতাশা থেকেই অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। আমরা সার্বিক অবস্থা এখনও পর্যবেক্ষণ করছি।
গত ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তিনি বলেন, নির্বাচন না আসা পর্যন্ত সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। ভোটের আগ মুহূর্তে জাপার প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহার হুমকির কারণেও হতে পারে, অর্থের অভাবেও হতে পারে। অনেক প্রার্থী অর্থশালী হয়ে থাকে না, অর্থের কারণেও অনেকে নির্বাচন থেকে সরে যায়।
অপরদিকে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. হাবিবুর রহমান পবনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল দুপুরে ইসি থেকে এ সংক্রান্ত একটা চিঠি জারি হয়। পবনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বদলির হুমকি দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে তলব করেছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের উপসচিব (আইন) মো. আব্দুছ সালাম সই করা প্রার্থিতা বাতিল সংক্রান্ত একটি চিঠি পবন বরাবর পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে, বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর প্রার্থিতা ফেরত চেয়ে আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একইভাবে বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতার বিষয়ে চেম্বার আদালতের দেয়া স্থগিতাদেশ চলমান থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ। ফলে তারা দুজন নির্বাচন করতে পারছেন না।