শীতকালে শিশু ও বৃদ্ধের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। অসুস্থ হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
—অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
সারা দেশে শীতের তীব্রতার সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, ঘটছে মৃত্যু। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধই বেশি। রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীই শীতকালীন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের নিউমোনিয়ায় বিভাগে গত চার দিন ভর্তি আছে আশিক রহমানের দুই বছরের শিশু। আশিক রহমানের সাথে কথা বলে জানা গেল, ঠাণ্ডা থেকে জ্বর ও কাঁশি হয়েছিল। সুস্থ না হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি, ডাক্তার বলছেন, তার শিশুর বুকে ঠাণ্ডা থেকে নিউমোনিয়া হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে ষাটোর্ধ্ব আমির হোসেনকে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছেন তার ছেলে মনির হোসেন। ডাক্তারের রুমের সামনে তার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, বাবার বাম পা হঠাৎ করেই অবশ হয়ে গেছে। কারো সহযোগিতা ছাড়া হাঁটতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, ঠাণ্ডাজনিত কারণে তার হাইপোথার্মিয়া হয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালেগুলোতে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর চাপ বাড়ছে প্রতিদিন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোল্ড ডায়রিয়া আর নিমোউনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ছয় দিনে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় তিন শতাধিক শিশু। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডগুলোতে বেড খালি না থাকায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ফ্লোরেও। এসব রোগীর বেশির ভাগই আসছেন রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে।
গত ডিসেম্বরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৪৩৭ শিশুকে ঢাকার বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (বিএসএইচআই) ভর্তি করা হয়েছিল। যা গত নভেম্বরের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। নভেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৩১৫। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। বছরে মারা যাচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার শিশু। পাঁচ বছরের কম বয়ীিশিশুদের মোট মৃত্যুর ২৪ শতাংশই হয় নিউমোনিয়ায়। গত পাঁচ বছরে প্রতি হাজারে প্রায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে নিউমোনিয়ায়। প্রতি বছর আনুমানিক ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে নতুন রোগী আনুমানিক ৪০ লাখ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশির ভাগই শীতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। শীতকালীন রোগব্যাধির পাশাপাশি তীব্র শীতে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে।
দেশে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত ও প্রতিকার নিয়ে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। যাদের শ্বাসনালির বিভিন্ন রোগ থাকে তাদের জন্য শীতকালীন সময়টা একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। শীতকালে আমরা নিউমোনিয়া দেখতে পাই। শিশু থেকে বৃদ্ধ এ সময়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। নিউমোনিয়ায় মৃত্যুও হয় অনেকের। শীতেকালে এক ধরনের কোল্ড ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া দেখা যায়। কোল্ড ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় মৃত্যু হারও অনেক বেশি। এটি ছোঁয়াচে রোগ। শীতকালে আমাদের দেশে অনেক রোগ হয়ে থাকে। সবগুলো রোগ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব এমনও নয়। তবে কিছু কিছু রোগের টিকা পাওয়া যায়। এগুলো প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তা ছাড়া শরীর গরম রাখতে গরম পোশাক পরতে হবে, গরম পানি খেতে হবে। এমনকি গোসলের ক্ষেত্রে গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এসব রোগে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে তাই তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। রুম গরম রাখতে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।