মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো কোনো কাজেই আসছে না। মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনেও ঠেকানো যাচ্ছে না ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অর্থনীতির সব সূত্র প্রয়োগ করেও মূল্যস্ফীতি পরীক্ষায় ফেল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে দুষছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে ব্যর্থতার ফল এটি। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমানভাবে এর দায় নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন সরকার গঠনের পরপরই বাজারে বাড়তে শুরু করেছে সব ধরনের পণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে চলতি জানুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে (১০ শতাংশের ওপর) চলে যাবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। তবে বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বারবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও দায়িত্ব নিয়েই হুঙ্কার দিয়েছেন নয়া বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।
ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়টি জোর গলায় বলে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতির পর গত নভেম্বরে ফের পরিবর্তন আসে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়। পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধরনের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে তথা ডিসেম্বরে ৮ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে (জুনে) ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের কথা জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে মুল্যস্ফীতিতে খুব একটা লাগাম পড়েনি। সামান্য কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ খুব একটা কাজে আসেনি। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ১৭ জানুয়ারি ঘোষিত হচ্ছে নতুন মুদ্রানীতি; যা গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে পাস হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে নিষ্ফল মুদ্রাব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকবে নাকি নতুন চমক থাকছে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও একদিন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্য বলছে, সুদহার আরও বাড়ানোর মাধ্যমে পুরোনো নীতিতেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় সামান্য কমেছে। এ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে, তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। নভেম্বরে এই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডিসেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আর শহরে এটি ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে গত ছয় মাসে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। ৯ থেকে বেড়ে চলতি জানুয়ারিতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে না কমলেও ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। আর বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ সময় খাদ্যশস্যের দামও কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যয়ও এ সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোনোটিরই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। পণ্যের দাম না কমে উল্টো গত এক বছরে দেশে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। গত বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল ছিল দেশের মানুষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী বুধবার জানুয়ারি-জুন এ ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে মুদ্রানীতির মৌলিক কাঠামো চূড়ান্ত হয়েছে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে মুদ্রানীতি কমিটির সভায়। অনুমোদিত মুদ্রানীতির খসড়া গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পাস হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত সংকুলানমুখী মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা দ্বিতীয়ার্ধেও থাকবে। এক্ষেত্রে সুদহার আরও বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। বাড়ানো হতে পারে নীতি সুদহার, রেপো, রিভার্স রেপোর মতো মুদ্রানীতির মৌলিক সুদ কাঠামোগুলোও। আর ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্দেশিত ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণের ঘোষণাও দেয়া হতে পারে। তবে এ নীতি বাস্তবায়ন ও কাঠামো ঠিক করতে আরও সময় নিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১১ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে নতুন মুদ্রানীতিতে বিশেষ ঘোষণা থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, ‘অর্থনীতির সামগ্রিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করে আমরা মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছি। এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংকুলানমুখী মুদ্রানীতিই প্রণয়ন করা হচ্ছে।’
এদিকে আমদানি এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমিয়েও ডলার সংকট কাটাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে তীব্র হয়ে উঠেছে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট। স্থবিরতা চলছে বেসরকারি বিনিয়োগেও। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ বাড়ছে সরকারের। বিপরীতে কমছে রাজস্ব আহরণ। অর্থ সংকটে পড়ে বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে ভর্তুকির দায় পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সরকারের তরফে। স্থবিরতা চলছে দেশের পুঁজিবাজারেও। অর্থনীতির নানামুখী সংকটের মধ্যেই চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাকে প্রধান লক্ষ্য ধরে নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে বলে জানান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ঋণের সুদহারকে ১৬-১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে হতে পারে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার এখনই প্রায় ১২ শতাংশে উঠে গেছে। এটিকে প্রতি মাসে ১ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট বা ব্যয়ের লক্ষ্য অন্তত এক লাখ কোটি টাকা কমিয়ে আনা দরকার। এটি হলে নতুন টাকা ছাপানোর প্রয়োজন হবে না।’ তবে কেবল সুদহার বাড়িয়ে-কমিয়ে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, ‘দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে মুদ্রানীতির সংখ্যাগত কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন দিয়ে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনৈতিক অন্য সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে হলে সুশাসন ও সংস্কার লাগবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর সুপারভিশন দরকার। করপোরেট সুশাসন না থাকলে কোনো নীতিতত্ত্বই কাজে আসবে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পের ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। বড়দের জন্য পুঁজিবাজার আছে, তারা তহবিল সংগ্রহের জন্য সেখানে যাক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা না থাকলে সেটি প্রণয়ন কিংবা ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ নেই।’
তিনি বলেন, ‘ডলার সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে জোর দেয়া দরকার। বিশেষ করে অবৈধ হুন্ডির তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। তৈরি পোশাক খাতকে আর তোষণ করার সুযোগ নেই। প্লাস্টিক, চামড়া, পাটসহ অন্যান্য পণ্য যাতে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারে, সেটির জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট অনেক দিক থেকে নেতিবাচক ধারায় চলছে। এটিকে ইতিবাচক করতে হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানো দরকার। কার্যকর আইনের শাসন ও সময়োপযোগী রীতিনীতি ছাড়া বিদেশিরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে না। কেবল রোড শো করে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।’