জনআতঙ্কের নাম ইউনাইটেড হাসপাতাল

নুর মোহাম্মদ মিঠু ও সাহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৪, ১২:০২ এএম
  • এবার হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা
  • ১৫ বছরে কতজনের মৃত্যু জানতে চেয়েছেন আদালত, আয়ানের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রুল  
  • সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় আরও বেশি শঙ্কিত চাপে থাকা আয়ানের পিতা শামীম আহমেদ

ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মানেই টাকা আর রোগীর জীবন নিয়ে খেলা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এমন অসংখ্য ঘটনার নজির সৃষ্টি করেছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ— যা চিকিৎসা খাতের ইতিহাসে বিরল। চিকিৎসায় অবহেলা, আর্থিক প্রতারণা, কথায় কথায় টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে রোগীর স্বজনদের হাতে রিসিপ্ট ধরিয়ে দেয়া, করোনাকালে নেগেটিভ-পজেটিভ সার্টিফিকেট প্রতারণা ছাড়াও চিকিৎসার নামে এহেন কোনো অপকর্ম সেখানে নেই যা এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করে না। সর্বশেষ সুন্নতে খতনা করতে গিয়ে ওই হাসপাতালে প্রাণ দিতে হয়েছে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে। চিকিৎসার নামে মানুষ হত্যার মিশনে থাকা এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন সরাসরি আক্রমণও করছে কম্পাউন্ডে যাওয়া বহিরাগতদের। তাদের পালিত গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরও। শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটির চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন দেখতে যাওয়ায় গতকাল সোমবার আমার সংবাদ ও বাংলাদেশ টাইমসের দুই সাংবাদিকের (মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার) ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালায় রাজধানীর সাতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লালিত গুণ্ডাবাহিনী। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় শুরু থেকেই চাপে থাকা শিশু আয়ানের বাবা শামীম আহমেদও বলছেন, তিনি এ ঘটনার পর থেকে আরও বেশি শঙ্কা বোধ করছেন। তিনি বলছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবার ওপরই এখন শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করছে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক ইমরান। জিডি সূত্রে জানা যায়, সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত সাতারকুলের ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনে গেলে সেখানে উপস্থিত থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক পরিহিত ১০-১২ জন তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা সাংবাদিক ইমরান ও মিরাজের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে থাকা অফিসের মোবাইল ফোন, বুম, মাইক্রোফোনসহ মাল্টিমিডিয়ার যাবতীয় সরঞ্জামও ভেঙে ফেলা হয়। এতে প্রায় এক লাখ টাকারও বেশি ক্ষতিসাধন হয়। শুধু তাই নয়, মারধরের পর আহত দুই সাংবাদিক হাসপাতালের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে সেখানেও হাসপাতালটির পোষ্য সন্ত্রাসীরা এসে দাবি করে ১০০ ফিট সড়কটিও তাদের। সেখান থেকেও তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়।
জানতে চাইলে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন গাজী গতকাল রাত ৮টার দিকে আমার সংবাদকে বলেন, ঘটনা জেনেছি। আমি আদালতে ছিলাম। মাত্রই থানায় আসলাম। আমি তাদের সাথে কথা বলব। ওই সময় ভুক্তভোগী দুই সাংবাদিক জানান, আমাদের নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছে বাড্ডা থানা পুলিশ। এখনো জিডির নম্বর দেয়া হয়নি। 

এদিকে সর্বশেষ আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শিশুটির পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে জারি করা রুলের জবাব দিতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। আয়ানের মৃত্যু কীভাবে, কী কারণে ঘটেছে তা যথাযথ অনুসন্ধানেরও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (ডিজি) প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালটির সাতারকুল ও গুলশান শাখায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কত রোগী মারা গেছে তাও জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শিশুর বাবা শামীম আহমেদের করা রিট আবেদনের প্রাথমিকভাবে শুনানি নিয়ে গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। 

আদালতে গতকাল রিটের পক্ষে আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। শুনানির সময় শিশুটির বাবা শামীম আহমেদও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। জনস্বার্থে স্বপ্রণোদিত হয়ে ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম রিটটি দায়ের করেন। এর আগে ‘লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরল না আয়ান : খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু’ শিরোনামে ৮ জানুয়ারি একটি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন। রিটে আবেদনকারী হিসেবে যুক্ত হন শিশুটির বাবা শামীম আহমেদ। পাশাপাশি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল ও নতুন রোগী ভর্তি না করাতে নির্দেশনা চেয়ে সম্পূরক আবেদন করে রিট আবেদনকারী পক্ষ। শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ আদেশ দেন। রিটে এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রুল জারির আবেদন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় জড়িত ডাক্তারদের সনদ বাতিল চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, হাসপাতালেরও নিবন্ধন বাতিলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আদেশের পর আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ বলেন, গত ১৫ বছরে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে কতজন মারা গেছেন, সে বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিন মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে। 

এদিকে হাইকোর্টের আদেশের পর আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছেন তিনি। আসলে এটাকে স্থায়ীভাবে সিলগালা করে দেয়া উচিত, যেহেতু এত বড় একটি ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। পাশাপাশি অভিযুক্ত কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। হাসপাতালের পরিচালকসহ দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করেছি। মামলা মামলার মতোই আছে। এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। ৯ জানুয়ারি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একজনও গ্রেপ্তার হয়নি।’ আমার সংবাদকে তিনি বলেন, আমি চাপে আছি। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় আমি আরও শঙ্কাবোধ করছি। প্রকৃতপক্ষে দোষীদের শাস্তি হবে কীনা এমন প্রশ্নও রেখেছেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত ৩১ ডিসেম্বর আনন্দের সঙ্গে রাজধানীর সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আয়ানকে। অনুমতি ছাড়াই ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে সুন্নতে খতনা করান চিকিৎসক। এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি তার। স্বজনরা জানান, আয়ানের সুন্নতে খতনার দিন অপারেশন থিয়েটারে মূলত ওই মেডিকেল কলেজের ৪০ থেকে ৫০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক ভেতরে ছিলেন। আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে চিকিৎসক আমাদের ডেকে বলেন, দুনিয়াতে আয়ান আর নেই। তারা খুব তড়িঘড়ি করে আমাদের বের করে দেন।’ আয়ানের পরিবারের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময় এমন ঘটনার পর অবস্থা বেগতিক দেখে সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ ইউনাইটেড হাসপাতালে। এমনকি প্রথমে ১০ হাজার টাকার প্যাকেজে অপারেশনের কথা থাকলেও বিল ধরানো হয় প্রায় ছয় লাখ টাকা। আয়ানের চাচা জামিল খান বলেন, আয়ান যদি দুনিয়াতে থাকত, তবে পুরো ছয় লাখ টাকাই নিতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখনো তারা আমাদের কাছে এই বিলটাই চাচ্ছে।

 তারা বলছেন, এখন আপনারা চলে যান, বিলটা পরিশোধের জন্য পরে এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অভিযোগ এড়িয়ে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় চাপাচ্ছে সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের ওপর। গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালের নন-মেডিকেল ডিউটি ম্যানেজার সানাউল্লাহ কবির সে সময় বলেন, প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনাসহ পুরো প্রক্রিয়াতেই দুই প্রতিষ্ঠান আলাদা। এ ঘটনা তদন্তে গত ৮ জানুয়ারি চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। সে হিসাবে প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটির হাতে সময় রয়েছে পাঁচ কার্যদিবস।