নতুন বছরের শুরুতে বড় ধাক্কা খেল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জানুয়ারির প্রথম ২১ দিনেই পৌনে দুই বিলিয়ন ডলার কমে ২০ বিলিয়নে ঠেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে পরিমাণ কিছুটা বেশি হলেও আইএমএফের চাহিদা মোতাবেক গণনাকৃত নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে অবস্থান করছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
আইএমফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখার কথা ছিল এক হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার। বছর শেষে প্রকৃত রিজার্ভ ছিল প্রায় এক হাজার ৬৭৫ কোটি ডলার। আগামী মার্চ শেষে রিজার্ভ রাখতে হবে এক হাজার ৯২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ ডিসেম্বরে এক বিলিয়নের ঘাটতিতে থাকা রিজার্ভ মার্চের লক্ষ্য পূরণে যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল সেখানে জানুয়ারিতে বড় পতন হলো। তাই ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সংস্থাটির জোড়ালো প্রশ্নের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিসহ বেশ কয়েকটি দাতাগোষ্ঠীর অর্থ সহায়তা আসে গত ডিসেম্বর মাসে। একই সঙ্গে বাজার থেকে এক বিলিয়নের বেশি পরিমাণে ডলার কিনে রিজার্ভে জমা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছর শেষে রিজার্ভের স্থিতি বেশি দেখাতে এমন কৌশল নিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে ধারাবাহিক কমতে থাকা রিজার্ভ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের পরও পর্যাপ্ত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। আইএফের শর্ত অনুযায়ী যে পরিমাণ রিজার্ভ জমা করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; তা করতে পারেনি। উল্টো চলতি মাসের শুরু থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। কারণ সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের আমদানি বিল বাবদ ১২৭ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে সংকট মেটাতে বাজারে প্রতিদিনিই ডলার বি?ক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে তেমন কোনো সুখবর নেই। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ জানুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল দুই হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার।
সংকটের কারণে ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় ২৪ জানুয়ারি তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫২৩ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এই ২১ দিনে রিজার্ভ থেকে ১৭৬ কোটি ৩০ ডলার কমে গেছে। তবে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিপিএম-৬ ম্যানুয়ালের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫২১ কোটি (৫.২১ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ অনুযায়ী এখন রিজার্ভ রয়েছে দুই হাজার দুই কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ২১ দিনে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৭৭ কোটি ডলার (১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী কমেছে ১৭২ কোটি ডলার (১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন)। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে গত ৩০ জুন গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ছয় বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়, প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সে হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে অর্থাৎ ১৫ বিলিয়নের ঘরে অবস্থান করছে। প্রতি মাসে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার করে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয় বাংলাদেশের জন্য। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন পিছিয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া এ মাসে আকুর বিলও পরিশোধ হয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় রিজার্ভ কমছে।
রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এছাড়া করোনার পর বৈশ্বিক বাণিজ্য এখনো আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে, যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। একই সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলারের মতো কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।