এখনও ফাইল চূড়ান্ত হয়নি, যোগ্যরা প্রাধান্য পাবেন
—মো. হাবিবুর রহমান, সিনিয়র সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগনিয়মের মধ্য থেকেই নিয়োগের সব
প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে
—এরাদুল হক, উপসচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ
দুর্নীতি, তছরূপ, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগে আড়ষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এবার শীর্ষ দুই পদে কর্মকর্তা নিয়েগে অনিয়মের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটিতে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও দ্বৈত নাগরিকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রার্থীদের কাউকেই সুপারিশের তালিকায় রাখা হয়নি, এমন চাউর উঠেছে কোম্পানিতে। এতে প্রাজ্ঞ ও প্রতিভাবান কর্মকর্তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই।
অন্যদিকে যোগ্য ও প্রাজ্ঞ প্রার্থী কি নেই— এমন প্রশ্নও রেখেছেন প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে জানান, ডিপিসিসিতে অনিয়ম নতুন কোনো ঘটনা নয়। এখানে নিয়োগে চলে উচ্চমহলে তদবির।
সূত্র বলছে, এই নিয়োগ কমিটিতে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ১৩ জন সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। ডিপিডিসির বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের পর আবেদনকারী প্রার্থীদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ২২ জানুয়ারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ১৬ জন এবং ২৪ জানুয়ারি নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে ১১ জন নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ডাক পেয়েছেন। এমডি পদে ১৬ জন পরীক্ষা দিলে বাছাইয়ের জন্য রাখা হয়েছে তিনজনকে। অন্যদিকে নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে ১৫ জন আবেদন করেন। মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পান ১১ জন। আর পরীক্ষা দেন আটজন।
তথ্যমতে, এমডি পদে সুপারিশকৃতরা হলেন— ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) এবং জিটুজি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ নোমান, ডিপিডিসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও জিটুজি প্রকল্পের সাবেক পিডি মাহবুবুর রহমান ও ডিপিডিসির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদার। এদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদারের বিরুদ্ধে আগে নানা অভিযোগ থাকলেও দ্বৈত নাগরিক মাহবুবুর রহমানের এমডি পদে সুপারিশ দেখে অনেকেই বিচলিত। এমনকি ডিপিডিসির এই এমডির নিয়োগ পেতেও তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে মোটা অঙ্কের লেনদেন করেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
মাহবুবুরের বিষয়ে অভিযোগ আছে, ডিপিডিসিতে থাকাকালে তার তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে শক্তিশালী দুর্নীতির সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি টেন্ডার বাণিজ্যসহ সব অনিয়ম-দুর্নীতি করিয়েছেন। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির প্রকিউরমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্রয়-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় তিনিই দেখতেন। নিয়েছেন কানাডার নাগরিকত্ব। দ্বৈত নাগরিক হয়েও এবার তিনি ডিপিডিসির এমডি পদ বাগিয়ে নিতে উচ্চমহলে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার পরও কিভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন— এমন প্রশ্নে নীরব ভূমিকায় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ডিপিডিসির প্রকৌশলীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। তিনি ২০১৯ সালে ডিপিডিসিতে কর্মরত থাকাকালে বছরখানেক কানাডায় অবস্থান করেও পুনরায় যোগদান করে নির্দ্বিধায় চাকরিতে বহাল হন। মাহবুবুর রহমান একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও কানাডার নাগরিক। দ্বৈত নাগরিক হয়েও সরকারি চাকরিতে থাকা বাংলাদেশের আইন পরিপন্থি। তার কানাডার পাসপোর্ট নম্বর এজি০৬২২০৮। আইনে বলা আছে, চাকরিতে বহাল থাকতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেউ দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে পারবেন না। অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের সাথে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে গিয়াস উদ্দিন জোয়ারদারের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও স্বেচ্ছাচারীমূলক আচরণের অভিযোগ থাকলেও তার সময়কালে তিনি গ্রাহকদের কাছে সাড়ে আট লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করেছেন। ৩২টি সাবস্টেশন করেছেন। তাছাড়া জিটুজি প্রকল্পের কাজগুলো তার সময় শুরু হয়। এ ছাড়া স্মার্ট মিটার, স্মার্ট গ্রিড প্রকল্প তার সময়কালে নেয়া।
অন্যদিকে, নির্বাহী পরিচালক (টেকনিক্যাল) পদে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনজন চূড়ান্তভাবে বাছাই হয়েছে। তারা হলেন— পিজিসিবির কর্মকর্তা প্রকৌশলী কিউএম শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির কর্মকর্তা প্রকৌশলী সৈয়দ আকরাম উল্লাহ ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মো. শরীফুল ইসলাম। এদের মধ্যেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মদক্ষতা নেই। তারা চাকরিজীবনে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করেছেন। একজন নির্বাহী পরিচালকের (টেকনিক্যাল) কাজ হচ্ছে ডিপিডিসির ৩৬টি জোনে বিদ্যুতের যে কোনো সমস্যা দেখভাল করা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবারহ, গ্রাহকের নানা সমস্যা সমাধান করতে হবে। সে বিষয়ে কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা নেই বাছাইয়ে উত্তীর্ণ তিন প্রার্থীর। আর এই ডিপিডিসিতে দুই প্রধান প্রকৌশলীসহ তিনজনকে বাছাই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি ভারী। তবুও তারা নানা তদবিরের কাছে হেরে গেছেন।
এ বিষয়ে জানার জন্য ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও নিয়োগ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব ও ডিপিডিসি নিয়োগ বোর্ডের সদস্য এরাদুল হক এ প্রসঙ্গে আমার সংবাদকে বলেন, এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। নিয়োগে অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। বেশ কিছু ধাপ শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। সম্মিলিতভাবে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটিই চূড়ান্ত হবে। তবে নিয়মের মধ্য থেকেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও ডিপিডিসির নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান বলেন, দ্বৈত নাগরিকের নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। তাছাড়া এখনো নিয়োগ ফাইল চূড়ান্ত হয়নি। এটাই ফাইনাল কথা। যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগে প্রাধান্য পাবে।