পণ্য বয়কটের আহ্বানে প্রকাশ্যে বিরোধী শিবির

আবদুর রহিম প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪, ১২:১৯ এএম

হঠাৎ সরকারবিরোধীরা রাজনৈতিক সভা-সেমিনার থেকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডিতে হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করা হচ্ছে

ভারতীয় পণ্য কিনবেন না; তাদের রেস্টুরেন্ট শোরুমে ঢুকবেন না
—নুরুল হক নুর

বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবন স্পটতই বাধাগ্রস্ত করছে ভারত সরকার

— ড আব্দুল মঈন খান

পলিটিক্যালি পণ্য বয়কটে সফলতার ইতিহাস রয়েছে বিশ্বব্যাপী 
—ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ

আমরা যত উদ্যোগই নিই, ভারতীয় পণ্য সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করবেই
—ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে সরকারবিরোধীরা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে একসময়ের ক্ষমতাধর বিএনপিও ভারতের বিরুদ্ধে কট্টর কথা বলা শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন সরকারকে ‘দিল্লির সরকার’ বলেও উল্লেখ করছে দলটি। একইসঙ্গে তাদের জোটসঙ্গী ভোটে না যাওয়া ৬৩টি রাজনৈতিক দলও একই নীতি গ্রহণ করেছে। তারাও ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলছে। রাজনৈতিক সভা-সেমিনার থেকে পণ্য বয়কটের আহ্বান করছে। বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা ভারতীয় পণ্য বয়কটের জন্য দলীয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ব্যক্তিগত আইডিতেও হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে। তার মধ্যে চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে ঢাকায় যত ভারতীয় পণ্য রয়েছে, ভারতীয় মালিকানাধীন গার্মেন্ট কোনগুলো, ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলো ইত্যাদি। দাবি হিসেবে গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার হরণ, কর্মসংস্থান হরণ, সীমান্তে মানুষ হত্যা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ভোটাধিকার হরণসহ বাংলাদেশে আলোচিত-সমালোচিত বড় যত ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলোতেই ভারতের ইন্ধন ছিল উল্লেখ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে দাবি তোলা হচ্ছে। 

রাজনৈতিক সভাগুলো থেকে বলা হচ্ছে, প্রতি বছর প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার ভারত বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। তার বিনিময়ে কিছুই দেয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সে জন্য ভারত যে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়েছে, দেশের জনগণ সেই দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সরকারি ভাষ্যমতে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লেও প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। তবে বিরোধী দলগুলোর ভাষ্য, প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষই ভোট বর্জন করেছে। এ নিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব দাবি তুলে জানান, জনগণ ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ায় সরকার প্রতিশোধ হিসেবে জনগণকে গ্যাস দিচ্ছে না, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সতেচন নাগরিকরা বলছেন, দেশের নাগরিকদের কাছে এবার নির্বাচনের পর অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আহ্বান রাজনৈতিকভাবে উঠেছে, এটি এখন বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার। যুগে যুগে পণ্য বর্জনের মাধ্যমে অনেক বিপ্লবী আন্দোলন ও দাবি সফল হওয়ার নজির রয়েছে বিশ্বে। 

সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়েছে। এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রশাসন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সর্বমহলে ভারতীয় এজেন্ট রয়েছে। এ দেশে সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগকেও বর্জন করুন, রাজপথে নামুন। আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতের গোলামি করলেও এ দেশের মানুষও ভারতের গোলামি করবে না। ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব  নেই। তবে আমাদের আপত্তি ভারতের শাসকদের পলিসি আর নীতি নিয়ে। তাই দল-মত নির্বিশেষে ভারতীয় এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে। সে কারণে ভারতীয় আধিপত্য হটাতে আমরা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছি। আপনারা কেউ ভারতীয় পণ্য কিনবেন না। এ দেশে কোনো ভারতীয় রেস্টুরেন্ট, শোরুমে ঢুকবেন না। ভারতীয় পণ্যের বিকল্প আমাদের তৈরি করতে হবে, উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে স্বাবলম্বী করতে হবে। 

ভারত-বাংলাদেশ রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ভারতীয়দের কাছে মুসলমানদের বহিরাগত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা ও গণতন্ত্রহীনতার মূল কারণ। হিন্দুত্ববাদের আধিপত্যবাদী নীতি ভারতকে তার প্রতিবেশীদের কাছে ক্রমেই আস্থাহীন ও অপােক্তয় করে তুলেছে। পাকিস্তান কিংবা চীনের কথা বাদ দিলেও ভারতের বাইরে বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল একটি ল্যান্ডলক্ড দেশ, নানাভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। একই অবস্থা ক্ষুদ্র পার্বত্য দেশ ভুটান কিংবা ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির কারণে শ্রীলঙ্কা বহু আগেই চীনের দিকে ঝুঁকেছে। একইভাবে নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপও এখন চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী এসব দেশের ওপর চীনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ভারতের চেয়ে বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কিংবা ভারতের প্রভাবাধীনে থেকে কোনো প্রতিবেশী দেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। অভিন্ন নদ-নদী, সমুদ্রসীমা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, নিরাপত্তা কিংবা আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতীয় শাসকরা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন স্পষ্টতই বাধাগ্রস্ত করছে ভারত সরকার। জনগণও সেটি বুঝতে পেরে স্ব-স্ব যায়গা থেকে উদ্যোগ নিচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি’

অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ‘ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, সেটিকে সমর্থন দেয়া। ভারত সরকার ও তাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের জনগণ কেন তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে। কেন ভারতের বিষয়গুলো নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে; কারণ একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন দিয়ে তারা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’ 

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ভারতীয় পণ্য বয়কট করার জন্য একটি ক্যাম্পিং চলছে। অক্টোবরে সারা দুনিয়ায় ইসরাইলি পণ্য যেভাবে বয়কট করার কারণে অনেকে নাম পরিবর্তন করতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে। অনেককে নতুন দোকান করতে হয়েছে। পলিটিক্যালি বয়কট করার বিষয় সারা দুনিয়ায় রয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও ভারতীয় পণ্য বয়কট সফল হবে। প্রতি বছর ২০-৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমরা ভারত থেকে ক্রয় করে থাকি। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স ভারতে যায়, সেটি তাদের দেশে সেকেন্ড অথবা থার্ড হবে। অবৈধ ইনকাম বাদ দিলে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর ভারত আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। ভারত অবৈধভাবে কীভাবে ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে— সেটা আমরা সবাই জানি। আমরা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই; কিন্তু কোনো অন্যায্য সম্পর্ক চাই না। ভারত আমাদের পরাধীন গোলামের মতো চালাবে— এটা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র; যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা দিল্লির গোলামি করব না। ব্যবসায় আমাদের ন্যায্যতা নেই, সীমান্তে ন্যায্যতা নেই। তারা বাংলাদেশকে যেভাবে ছোট করে উপস্থাপন করছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের অবৈধ সংসদকে ভারত বারবার বৈধতা দিচ্ছে। আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে— এটা বন্ধ করতে হবে 

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, দেখুন বয়কটের যে বিষয়টা, তা ব্যক্তিগত ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত। এখানে চাহিদার একটা বিষয় আছে। এ দেশের মানুষ যদি সিদ্ধান্তে চূড়ান্তে থাকতে পারে, তাহলে ভিন্ন কিছু হলেও হতে পারে। কিন্তু দেখুন, বাংলাদেশের প্রায় চারদিকেই ভারতের অবস্থান। জলে-স্থলে সব দিক থেকেই তারা। আমরা যত উদ্যোই নিই না কেন, বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করবেই। এটাকে ঠেকানো যাবে না। এটাকে না ঠেকানো গেলে মনে হয় ভারতীয় প্রভাব থেকে বেরিয়ে খুব কিছু একটা করারও সুযোগ নেই। বয়কট করলেও এখানে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে না।