আদালতে বিচারকাজ বাংলা ভাষায় হলেও বোধগম্য বাংলা ভাষার অভাব থেকে যাচ্ছে। আবার উচ্চ আদালতে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজির প্রাধান্য থাকায় সৃষ্টি হয় বিড়ম্বনা। ইংরেজি ভাষায় রায় ঘোষণা হওয়ায় বিচারপ্রার্থীর রায়ের বিষয়বস্তু বা কারণ বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব বিড়ম্বনা এবং আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাও হয়ে আসছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে। অথচ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে রক্ত ঝরলেও গত ৭২ বছরেও অর্জিত হয়নি রাষ্ট্রভাষার অধিকার। ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষাসৈনিকরা বলছেন, আমরা রাষ্ট্রভাষার অধিকার পাইনি। তাদের বিবেচনায় প্রশাসন থেকে প্রাত্যহিক জীবনের কোথাও বাংলার গুরুত্ব নেই। তবে বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণয়ন করা হয়।
এ আইনের ৩ ধারায় আইনটির প্রবর্তন ও কার্যকরী ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনি কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। যদিও কালেভদ্রে দু-একজন বিচারপতির বাংলায় রায় লেখার মধ্যেই এখন বাংলাচর্চা সীমাবদ্ধ। এখনো পর্যন্ত উচ্চ আদালতে ব্যাপকভাবে বাংলার প্রচলন ঘটেনি। উচ্চ আদালতে বাংলার জন্য দুয়ার না খোলায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে অনেকেই আদালতপাড়ায় ভাষা হিসেবে বাংলার সীমাবদ্ধতার কথা বলে এড়িয়ে যেতে চান; কিন্তু কাউকে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।
যদিও ২০১৪ সালে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ অনুযায়ী অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব ধরনের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক, গাড়ির নম্বরপ্লেট ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী দূতাবাস ও বিদেশ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য করা হলেও বাস্তবায়নে দৈন্য স্পষ্ট।
এদিকে ভাষা আন্দোলনের মাস এলেই কেবল বিষয়টি আলোচনায় আসে এবং এ বিষয়ে আমাদের আবেগ উথলে পড়ে। আবার ফেব্রুয়ারির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের যে স্ফুলিঙ্গ ৫২তে ছড়িয়েছিল, তার চেতনা কিন্তু এরকম ছিল না। বরং সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের নিমিত্তেই ভাষাশহীদরা নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, চাইলে রাতারাতিই আদালতের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব। এটা জনগণকে ভয়াবহভাবেই চাইতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইনজ্ঞদের কেউ কেউ আরও বলছেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা বলছি আমাদের আইন বাংলায় হতে হবে— যখন বাংলা ভাষা বিশ্বের ভাষা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে ওঠেনি।
আদালতে মামলার রায় অধিকাংশ সময়ই ইংরেজিতে দেয়ার কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে আদালতের কথার মর্ম ঠিকমতো উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। ফলে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলাগুলোতে যুগান্তকারী রায় পাওয়া গেলেও কেবল ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে এ দেশের গণমানুষ তার সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের রায়গুলো বঙ্গানুবাদ করে জনমানুষের জন্য আইন ও বিচারের বাণী সহজলভ্য করতে সরকারের এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত। আইনকে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার উপযোগী করে ব্যবহার করতে হলে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের বিকল্প নেই। তাই আইন শিক্ষা থেকে শুরু করে বিচারের শেষ স্তর পর্যন্ত সর্বত্র বাংলার পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। যথাযথ গবেষণার ব্যবস্থা করা হলে তা বেশি সময়সাপেক্ষ হবে না। বরং সহজ বাংলার ব্যবহার আইনকে আরও মাধুর্যময় করবে। আইন তখন আর কোনো খটমটে দুর্বোধ্য বিষয়ে পরিণত হবে না। তবে ভাষান্তরের ক্ষেত্রে সহজ এবং সবার জন্য বোধগম্য শব্দচয়ন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আইনি শব্দকোষ থেকে শুরু করে স্বল্প পরিসরে মূল আইনগুলো বাংলায় ভাষান্তরের কারণে ইতোমধ্যে প্রাণহীন আইনও যথেষ্ট সরস হয়ে উঠেছে। এখন প্রয়োজন শুধু বাংলার জন্য রুদ্ধ দুয়ার উন্মুক্ত করা এবং নিরবচ্ছিন্ন চর্চা চালিয়ে যাওয়া।
তবে এ কথাও সত্য যে, আইনি অনেক শব্দের পরিভাষা বাংলায় নেই বা অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলায় আইনবিষয়ক শব্দের ভাণ্ডার খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে ভাষার সব দ্যোতনাও বাংলায় সব সময় সঠিকভাবে প্রকাশ করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে সরকারি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আইনের পারিভাষিক শব্দগুলোর অভিধান তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। ব্যবহার করতে করতেই এক সময় পরিভাষা দাঁড়িয়ে যায়। তাছাড়া এখন তো আইনগুলো আইনসভা বাংলাতেই প্রণয়ন করছে। তাহলে উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনে সমস্যা কোথায়? এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যাও বটে। অনেকে উচ্চ আদালতে ইংরেজি ব্যবহার করে এক ধরনের দম্ভ প্রকাশ করেন। এটা ঔপনিবেশিক মানসিকতারই একটি অংশ। আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি অন্তরে ধারণ করতে পারিনি। উচ্চ আদালতের পাশাপাশি নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতির জন্য কমপক্ষে তিনটি মামলার রায় ইংরেজিতে লেখার নিয়মও আদালতে বাংলার সার্বিক প্রচলন বাধাগ্রস্ত করছে।
দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করা হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে— ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ আইনটি প্রণয়ন করার দীর্ঘ সময় পর ১৯৯৮ সালের শেষদিকে বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন করা হয়। কোষের কর্মপরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রিটিশ আমল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতে প্রযোজ্য ইংরেজিতে প্রণীত আইন বাংলা ভাষায় রূপান্তর। কিন্তু পরবর্তীতে সে কার্যক্রমও গতি হারিয়ে ফেলে।