গবেষণা বাড়ানোর জন্য সরকারের আন্তরিকতা বেশি প্রয়োজন
—ড. মঞ্জুরুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাবি
গবেষণায় অবহেলা করলে আমাদের করার কিছু থাকে না
—ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, সদস্য, ইউজিসি
উচ্চশিক্ষার সঙ্গে গবেষণার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। উচ্চশিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য গবেষণা। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান, সামাজিক, কলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে গবেষণাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। আইন থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশই এ আইন পালন করছে না। নামমাত্র অর্থ ব্যয় করেই দায় সারছে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি বলছে, গবেষণায় অবহেলা করলে তাদের করার কিছুই থাকে না। সারা বছর তদারকির সিস্টেম না থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। তবে ব্র্যাকসহ ১১ বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি আইন পালন করেছে। সম্প্রতি ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে ১০০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে ৮৯ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি আইন পালন করেনি। ১৫টি গবেষণায় এক টাকাও খরচ করেনি। এক লাখের কম খরচ করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২টি। এর ফলে লঙ্ঘিত হয়েছে, ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন। ইউজিসি আইন ২০১০, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রের শর্তাবলির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ১
ধারা ৭ এর অধীন সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই আইনের অধীন সনদপত্রের জন্য নিম্নবর্ণিত শর্তাবলি পূরণ করিতে হইবে। সাত শর্তের মধ্যে ৬ নং শর্ত হলো— বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক বাজেটের ব্যয় খাতে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একটি অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দপূর্বক তা ব্যয় করতে হবে। ইউজিসি মোট ব্যয়ের ২ শতাংশ গবেষণায় খরচের নির্দেশনা দিয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রেরিত তথ্যানুযায়ী ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কমবেশি অর্থ খরচ করেছে। এ খাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বমোট ব্যয় ছিল ১৩৯ কোটি ৩১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। গড় হিসাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। এ খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ করেছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ব্যয়ের ৬ শতাংশের বেশি।
গবেষণার না করার ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পর গবেষণায় ব্যয় করার মতো তাদের কাছে তেমন অর্থ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেই হিমশিম খেতে হয়। নিজস্ব অর্থ থেকে গবেষণা করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকার যদি গবেষণা বাবদ তাদের কোনো অর্থ প্রদান করত তাহলে সেটি সম্ভব হতো।
এ ব্যাপারে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আমার সংবাদকে বলেন, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অনেক ধরনের খরচ থাকে। শিক্ষার্থীদের থেকে তাদের সব আয় আসে না। দাতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ব্যয় মিলিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খরচ করেন। এরপর আবার নিজস্ব ব্যয়ে গবেষণা করার মতো অর্থ তাদের নেই। সরকার যদি কিছু টাকা ভর্তুকি দিতো তাহলে আমরা গবেষণায় ব্যয় করতে পারতাম। গবেষণায় ব্যয় করেও ইউজিসির ২ শতাংশের নিচে ব্যয় করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জানিয়েছে, তারা গবেষণায় কিছু ব্যয় করেছে। এবার এর বেশি সামর্থ্য ছিল না। আগামীতে আরো বেশি ব্যয় করার কথা জানান তারা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় আরো তদারকির কথা জানিয়ে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ আমার সংবাদকে বলেন, গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বপ্রণোদিত হওয়া উচিত। তারা গবেষণায় অবহেলা করলে আমাদের করার কিছু থাকে না। অবহেলা করলে তাদের শাস্তি দেয়া যায় না। বছর শেষে আমরা একটা তথ্য পাই। তথ্য পাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারি তারা গবেষণা করেনি।
গবেষণাসহ অন্যান্য আইন পালন হচ্ছে কি-না এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক তদারকির একটি পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন। গবেষণায় আরো বেশি মনেনিবেশ করার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শতাধিককে একই দাগে ফেলে দেখা উচিত নয়। এদের মধ্যে ১০টি আছে, যারা গবেষণায় প্রচুর ব্যয় করে। নর্থ সাউথ বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যে অর্থ গবেষণায় দেয় তা ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে না। এই ১০টির বাইরে আরও ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা যথেষ্ট গবেষণা করে এবং গবেষণা কাজে শিক্ষকদের উৎসাহ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। আমি ইউল্যাব নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিজেদের প্রয়োজনে ও প্রচেষ্টায় গবেষণা প্রবন্ধ ছাড়া আর কোনো গবেষণা হয়না। এরা মূলত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এরা শিক্ষকদের খাটায় বেশি, কিন্তু বেতন-ভাতা দেয় অনেক কম। এদের অর্থ উপার্জন ছাড়া গবেষণা, নিয়মিত সেমিনার বা গবেষণাধর্মী কার্যক্রম, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কাজকর্ম বা শিক্ষার্থীবান্ধব কোনো কাজে উৎসাহ নেই।
ইউজিসির চেষ্টার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে এদেরকে একটা নিয়মের মধ্যে আনা যায়, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না প্রধানত দুটি কারণে। ইউজিসির লোকবলের অভাব এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকপক্ষের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মঞ্জুরি কমিশনকে খুব একটা তোয়াক্কা করে না। তাই এই সমস্যার সমাধান সরকার আন্তরিক হলেই শুধু সম্ভব। গবেষণায় শিক্ষকদের উৎসাহিত করার কথা জানিয়ে এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, আমি কয়েক বছর ইউল্যাবে পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালোই খরচ করে। স্কোপাস ইন্ডেক্সড জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ হলে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে গবেষককে পুরস্কৃত করে।