এনআরবিসি ব্যাংকে অনিয়ম

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন এমডি

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৪, ১২:২৮ এএম

অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও পর্ষদে বিশৃঙ্খলার কারণে মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ ও আমানত দক্ষতার সঙ্গে দেশে কাজে লাগানোর জন্যই এনআরবিসি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে প্রবাসীরাও এখন ব্যাংকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এনআরবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে মাত্র শূন্য দশমিক ২০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। 

আর সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অনিয়ম সামনে এসেছে এগুলোর সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছেন ব্যাংকটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও প্রধান নির্বাহী গোলাম আউলিয়াও। এমনকি অনিয়ম চাপা দিতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে মিথ্যা তথ্যও দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংকে ট্রেইনি অফিসার পদে লোক নিয়োগের পরীক্ষায় পর্ষদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া।

এ বিষয়ে কথা বললে অর্থনীতি বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, মূলত অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনৈতিক বিবেচনার ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যাংকগুলো প্রথম থেকেই শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো ব্যাংকগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারেনি। যার কারণে ব্যাংকগুলোতে নানা অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের অনিয়ম-জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের বোর্ড ও এমডি জড়িত। বোর্ড মেম্বারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এমডিরা এসব ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংক খাতে বর্তমানে কোনো সুশাসন নেই। সুশাসন না ফিরলে অনিয়মও বন্ধ হবে না এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৩ মার্চ ২০২২ অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির ১৩৬তম পর্ষদ সভায় ট্রেইনি অফিসার পদে নিয়োগের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানের— ১. ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ২. বিআইবিএম; ৩. আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৪. বিয়াম) যেকোনোটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অনুমোদন দেয়া হয়। যার বিপরীতে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে মৌখিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিক্ষকদেরকে ব্যাংক থেকে পাঠানো চিঠির কপি চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিদর্শন দলকে তা সরবরাহ করতে পারেননি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া জানান, আলোচ্য নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এমনকি নিয়োগ পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিশ্চিতে দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে কোন ‘ওপেন টেন্ডারিং’ প্রক্রিয়াও গ্রহণ করা হয়নি।

এ ছাড়া উল্লিখিত অনিয়ম চাপা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আসা পরিদর্শন দলকে মিথ্যা তথ্যও দিয়েছিলেন এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শনকালে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করার উদ্দেশে নিয়োজিত শিক্ষকদেরকে প্রদত্ত সম্মানীর রিসিট-ভাউচার চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা প্রদর্শন করতে পারেননি। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পরিদর্শন দল প্রদত্ত স্মারকের জবাবের সঙ্গে শিক্ষকদের স্বাক্ষরিত মানি রিসিট সংযুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে, ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারে ‘অনারিয়াম-ট্রেইনার ফি’ নামীয় খরচ খাতের (জিএল এ-সি : ৯০৪০৩১৯০৯০৩০১০১) ১ এপ্রিল ২০২২ থেকে ৩০  এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত বিবরণীতে শিক্ষকদেরকে প্রদত্ত সম্মানীর কোনো এন্ট্রি পাওয়া যায়নি। ফলে এটি স্পষ্ট যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিক্ষকদেরকে প্রদত্ত সম্মানীর বিষয়ে পরিদর্শন দলের স্মারকের জবাবে জ্ঞাতসারে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন যা ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ১০৯(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি, যা ব্যাংকটির প্রকিউরম্যান্ট অ্যান্ড এক্সপেনডিচার ম্যানেজমেন্ট পলিসি এর লংঘন। ওই নীতিমালার ২ ধারা মোতাবেক ব্যাংকটির সব পণ্য এবং সেবা ক্রয় ওই নীতিমালার আওতায় পরিচালিত হবে। নীতিমালাটির ৩ ধারায় পণ্য বা সেবা ক্রয় প্রক্রিয়ার তৃতীয় ধাপে দরপত্র আহ্বানের উল্লেখ রয়েছে। তথাপি, কোনো দরপত্র আহ্বান ব্যতিরেকে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন শিক্ষককে প্রদান করে ব্যাংকের নিজস্ব ক্রয় নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এতে করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যাতে ব্যাংকটিতে চলমান সুশাসনের অভাব সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। 

এ ছাড়া, ট্রেইনি অফিসার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্ষদের সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকটির হিউম্যান রিসোর্সেস পলিসি ম্যান্যুয়াল এর অনুচ্ছেদ ২.১৩.২ এবং ৬.২ মোতাবেক ব্যাংকের কোনো কর্মীকে পর্ষদ-ব্যবস্থাপনা সর্বোচ্চ তিনটি ইনক্রিমেন্ট দিতে পারে। কিন্তু, ব্যাংকটির ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ অফিস নোটের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনে বিভিন্ন পর্যায়ের ২৭ জন কর্মকর্তাকে চারটি থেকে শুরু করে ১৩টি পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে (উদাহরণ: কাজী মো. শাফায়েত কবির, এসইভিপি, ১৩টি; মোহাম্মদ কামরুল হাসান, এডিপি, ১৩টি; মো. শফিকুল ইসলাম, এফএভিপি, ১৩টি এবং মো. রাশেদুল আলম, এভিপি, ১২টি ইনক্রিমেন্ট); অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট প্রদানের কোনো কার্যকারণ উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য, পরবর্তীতে ১৪ মার্চ ২০২২ অফিস নোটের মাধ্যমে প্রদানকৃত ইনক্রিমেন্ট বাতিল করা হয় এবং প্রদত্ত ইনক্রিমেন্টসমূহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হিসাব থেকে ফেরত নেয়া হয়। তবে, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ওই অনিয়ম করা সত্ত্বেও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে এনআরসিবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়ার ফোনে ফোন কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। বিষয়টি উল্লেখ করে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেননি।