জোর করে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না
—ড. যতীন সরকার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ
শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্ররাজনীতি চালু হতে পারে
—ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার, উপাচার্য, বুয়েট
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নাটক বন্ধ করতে হবে
—সাদ্দাম হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির
বিরুদ্ধে নয়, ছাত্রলীগের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে
—রাকিবুল ইসলাম, সভাপতি, ছাত্রদল
ছাত্রলীগের বিরোধী মত নির্মূলের ঘৃণ্য রাজনীতি ছাত্রশিবিরকে শক্তিশালী করবে
—রাফিকুজ্জামান ফরিদ, সাধারণ সম্পাদক সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট
আবরার ফাহার হত্যার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কয়েক দফা ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ বেড়ে যাওয়া শঙ্কা থেকেই এমন চেষ্টা করে আসছে প্রগতিশীল সংগঠনটি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে বারবার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। এরই প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা বর্জন করে জানাচ্ছেন প্রতিবাদ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররাজনীতি ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে আলোচনা। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে ছাত্রলীগকে দায়ী করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য বলেছেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্ররাজনীতি চালু হতে পারে।
জানা গেছে, গতকাল টানা তৃতীয় দিনের মতো বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখাসহ বেশ কিছু দাবিতে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দাবি বাস্তবায়নে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন তারা। তবে গতকালের পরীক্ষায় একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী ও একজন অনিয়মিত শিক্ষার্থী ব্যতীত অংশ নেননি কোনো শিক্ষার্থী। ২০তম ব্যাচের এক হাজার ২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এক হাজার ২১৪ জনই পরীক্ষায় অংশ নেননি। এর ফলে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবস্থান প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক সময়সূচি অনুযায়ী, এখন শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বর্জনের কারণে এসব পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বুয়েটে গতকালের পরীক্ষায় অংশ না নেয়া ও চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বুয়েটের বাইরে বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য তাদের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে না; বরং তাদের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে যারা ওই দিন রাতে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় নিয়ম অমান্য করে বুয়েটের ভেতরে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে অনুপ্রবেশ করে। ক্যাম্পাসে, হলে কিংবা ক্লাসে কারও উপর কোনো রকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। ওই অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যাচার। ছাত্রলীগ বাদে অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা নিষিদ্ধ সংগঠনের ব্যাপারে বুয়েট শিক্ষার্থীরা সক্রিয় নয় এমন অভিযোগের ব্যাপারে তারা বলেন, এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারা সব সময় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন। এমন অভিযোগ প্রমাণ পেলে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলনে নামবেন।
এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মনে প্রাণে ধারণ করি। জাতীয় দিনগুলোতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক উদযাপন ও অংশগ্রহণ এবং সম্যকভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিরই প্রমাণ। এটি প্রমাণ করার জন্য আবরার ফাহাদের মৃত্যুর পর ক্যাম্পাসের সব সাধারণ শিক্ষার্থীর সিদ্ধান্তকে অবমাননা করে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই।
বুয়েটের ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. যতীন সরকার আমার সংবাদকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে বিরূপ ধারণা জম্ম নিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা চাচ্ছে না পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসুক। এটি তারা চাইতেই পারে। জোর করে পুনরায় তাদের উপর ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী আমার সংবাদকে বলেন, রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের অধিকার। রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা যায় না। একটি সমস্যার কারণে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই ঘটনা যেন পুনরায় না ঘটে। রাজনীতির কারণে যেন শিক্ষার পরিবেশে বিঘ্ন না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভালোভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করাই সমাধান নয়।
বিরোধী ছাত্র সংগঠনের বক্তব্য : বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতারা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘটনায় ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব আমার সংবাদকে বলেন, এটি ছাত্রলীগের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য যে, সাধারণ ছাত্রদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব সময় তাদের অবস্থান। বুয়েটের যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এর জন্য ছাত্রলীগ এককভাবে দায়ী। ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নয়; বরং ছাত্রলীগের অপরাজনীতির বিরুদ্ধেই আন্দোলন করছে। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, বুয়েটে আজকে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার দায় কোনোভাবেই ছাত্রলীগ এড়াতে পারে না। এই সংগঠন রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং দখলদারিত্ব চালাত। বুয়েট ক্যাম্পাসের হলগুলোকে টর্চার সেলে পরিণত করেছিল। এদের দৌরাত্ম্য এবং দখলদারিত্ব এতটাই তীব্র ছিল যে, শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে তারা পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের কথা ওঠে। অনেকটা সন্ত্রাস, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি ওঠে। সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের এ মনোভাবের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা বলতে চাই, ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বিঘ্নিত হলে অগণতান্ত্রিক-ফ্যাসিস্ট শক্তি জেঁকে বসে। দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস, সামপ্রদায়িকতা ইত্যাদি তারই ফল।
তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগ যেভাবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘শিবিরের আন্দোলন’ এবং আন্দোকারীদের ‘শিবির’ বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অন্যায্য। এটি কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। যেকোনো বিরোধী মতকে শিবির বলে চিহ্নিত করে ছাত্রলীগ যেমন বিরোধী মতকে নির্মূলের ঘৃণ্য পথ বেছে নিচ্ছে, একই সাথে এ প্রক্রিয়া ছাত্রশিবিরের রাজনীতিকে শক্তিশালী করছে। পুরো বিষয়টি ছাত্রসমাজকে ভেবে দেখার আহ্বান জানাই।
এদিকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে নাটক বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ। সমাবেশে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা আজ এখানে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি। বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি, সংবিধান পরিপন্থি, শিক্ষাবিরোধী সিদ্ধান্ত। এ সময় তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেনের সিট বাতিলের সিদ্ধান্ত তুলে নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘রাব্বির অপরাধ কী? সে ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনে, যিনি বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, তার জন্মদিনে ইফতার বিতরণ করেছে। ২৬ মার্চ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। এই দেশের পতাকা, এই দেশের মানচিত্র এই দেশের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য যে সংগঠনের কর্মীরা রক্ত দিয়েছে, সেই সংগঠনের কর্মী হওয়ার কারণে কাউকে যদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় সেই এলাকাকেই নিষিদ্ধ করতে হবে।’ ছাত্রলীগ সভাপতি আরও বলেন, ‘এই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার নাটক বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় নাগরিক হিসেবে যাওয়ার অধিকার আমার হয়েছে। তাদের কাছে পারমিশন নিতে হবে? যে অধিকার আমাকে সংবিধান দিয়েছে তাকে আপনারা ঠুনকো বানিয়ে দেবেন এবং সেটি আমরা মেনে নেবো, এই আশা যারা করছে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। বুয়েট কি পাকিস্তান যে ভিসা-পাসপোর্ট দিয়ে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হবে?’
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে ‘অন্ধকারের রাজনীতি’র চাষাবাদ হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সাদ্দাম হোসেন। এ সময় তিনি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর পাশাপাশি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেও কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েটে আবার ছাত্ররাজনীতি চালু হতে পারে : শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আবার ছাত্ররাজনীতি চালু হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। গতকাল উপাচার্য তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। উপাচার্য বলেন, ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের গড়ে ওঠার জন্যই দরকার। বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে আবার ছাত্ররাজনীতি চালু হতে পারে। গত বুধবার রাতে কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালায়। এর প্রতিবাদে তারা বিক্ষোভ করছে। দাবি আদায়ে পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, তদন্ত কমিটি কাজ করছে, রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেবো। আর পরীক্ষা ওপেন আছে, কেউ চাইলে দিতে পারে। প্রসঙ্গত, গত শনিবার উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে আমরাও সহমত। কিন্তু এগুলো পূরণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য সময় প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে এর প্রতিবাদে টানা দুদিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, বুধবার রাত দেড়টায় বুয়েটের মূল ফটক দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন ছাত্রলীগের অন্তত ৭০-৮০ জন নেতাকর্মী। সাদ্দাম হোসেনও সেখানে ছিলেন। তারা ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে বৈঠক করেন, সেখানে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে ক্যাম্পাসে ‘শোডাউন’ করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ছাত্রলীগ নেতা ও বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রহিমের হল সিট বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।