এস এম নুরুজ্জামান জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বরত। তিনি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে দীর্ঘ এক যুগ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এ ডিএমডি (উন্নয়ন প্রশাসন বিভাগ) পদেও কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিষদ সদস্য। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হন দৈনিক আমার সংবাদের। জানান, নানা অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের অনাস্থায় পরিণত হওয়া বিমা খাতকে আশার আলো দেখাচ্ছে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির সততা আর ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিমা খাতের বিভিন্ন দিকসহ জেনিথের কার্যক্রম তুলে ধরেন তিনি।
দৈনিক আমার সংবাদের জন্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ইমরান খান
আমার সংবাদ : জেনিথ অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম কেন এবং আপনাদের ব্যবসা পলিসি কী?
এস এম নুরুজ্জামান : জেনিথ ইসলামী লাইফ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য বিমাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির স্বাস্থ্য বিমার আওতায় রয়েছে। বিমা দাবি পাওয়ার জন্য তেমন কষ্ট করতে হয় না শিক্ষার্থীদের। খুব সহজে টাকা পাওয়ার জন্য তাদের বিমা দাবির কাগজপত্র ছবি তুলে অনলাইনে সাবমিট করলে ডিজিটাল মাধ্যম অর্থাৎ বিকাশ, নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে টাকা পেয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।
স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার জন্য ইআরপি সলিউশনের মাধ্যমে গ্রাহককে খুব দ্রুত তাদের পাওনা পরিশোধ করে জেনিথ ইসলামী লাইফ। গ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের লোকজন এবং গ্রাহকদের স্বার্থে ওয়েবসাইট এবং অ্যাপস বাংলা ও ইংরেজি দুই ভার্সনে করে দিয়েছি আমরা। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ঘরে বসে গ্রাহক তার মাস্টার কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ভিসা কার্ড, বিকাশ, নগদ, রকেট যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে ডিজিটাল সিস্টেমে ইচ্ছামাফিক প্রিমিয়াম জমা নিতে পারে। আমরা আমাদের কর্মীদের ট্রেনিংয়ের জন্য ট্রেনিং ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুলেছি এবং এর মাধ্যমে আমরা তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলছি।
আমার সংবাদ : জেনিথের কতটি শাখা ও গ্রাহক সংখ্যা কত?
এস এম নুরুজ্জামান : সারা দেশে জেনিথের বর্তমানে ৫০ হাজারেরও বেশি সক্রিয় গ্রাহক নিয়ে প্রায় ৭০টি শাখা রয়েছে। ২০২২-২৩ সালে আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে। আমরা শতভাগ ক্লেইম পরিশোধ করেছি। আমরা নতুন করে ২০২৪ সালে শেয়ার মার্কেটে গেছি। আগে শুধু আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে এফডিআর, ট্রেজারি বন্ড ছিল।
আমার সংবাদ : জেনিথ কী ব্যাংকান্স্যুরেন্সে অংশগ্রহণ করেছে? এর মাধ্যমে বিমা খাত কতটুকু ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন?
এস এম নুরুজ্জামান : জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ইতোমধ্যে ব্যাংকাসুরেন্সে অংশগ্রহণ করেছে। হজ বিমা, দেনমোহর পলিসি, প্যানশন পলিসি, শিশু বিমাসহ জেনিথের প্রায় ২০টির মতো প্রোডাক্ট আছে। আর আমরা আশা করি এই ব্যাংকাসুরেন্সের মাধ্যমে বিমা খাত ঘুরে দাঁড়াবে। বিভিন্ন কারণে বিমা খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর হয়ে যাবে। ব্যাংকের লোকজন যখন মানুষকে বিমার কথা বলবেন তখন বিমা নিয়ে মানুষের মধ্যে আর কোনো সংশয় থাকবে না। বছর শেষে ভালো একটি ফলাফল আসবে।
আমার সংবাদ : জেনিথের বর্তমান অবস্থা কী?
এস এম নুরুজ্জামান : সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সমাপনী বছর ২০২৩ সালে জেনিথ ইসলামী লাইফের ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় কমেছে। অপরদিকে বেড়েছে কোম্পানির লাইফ ফান্ড ও বিনিয়োগের পরিমাণ। বছর শেষে জেনিথের লাইফ ফান্ডে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০২ শতাংশ, বিনিয়োগ বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আর ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমেছে ১৪ শতাংশ। সমাপনী হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে জেনিথ ইসলামী লাইফ মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৩০ কোটি তিন লাখ টাকা। এই প্রিমিয়াম সংগ্রহে ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করেছে মোট প্রিমিয়ামের ৫৬.৩৮ শতাংশ।
এর আগে ২০২২ সালে জেনিথ ইসলামী লাইফের মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ৩০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর এই প্রিমিয়াম সংগ্রহে কোম্পানিটির ব্যয় হয়েছিল ২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সে বছর কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়ামের ৭০.৭৬ শতাংশ ব্যয় করেছিল ব্যবস্থাপনা খাতে। এই হিসাবে ২০২৩ সালে জেনিথ ইসলামী লাইফের ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমেছে ১৪.৩৮ শতাংশ। তবে অনুমোদিত ব্যয়সীমার চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
২০২৩ সালে বিমা কোম্পানিটির সংগৃহীত মোট প্রিমিয়ামের মধ্যে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা, দ্বিতীয় বর্ষ পাঁচ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং তৃতীয় ও তদুর্ধ্ব বর্ষের প্রিমিয়াম ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন সংগ্রহের হার বেড়েছে ৬.৭৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রিমিয়াম তামাদির হার কমেছে।
আমার সংবাদ : কিছু কোম্পানি যথাসময়ে বিমা দাবি পরিশোধ করছে না। এতে বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ওঠে যাচ্ছে। আপনি এটিকে কীভাবে দেখছেন?
এস এম নুরুজ্জামান : অনেক কোম্পানি বিমা দাবি পরিশোধ করছে না এর কারণে আমরাও ব্যবসা করতে পারছি না। বিমার প্রতি মানুষে আস্থার সংকট, এর জন্য আইডিআরএকে ভূমিকা রাখতে হবে। একটি কোম্পানি ডাউনের মূল কারণ হচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম। ২০১০ সালে এ ধরনের ক্রাইমের জন্য একটি বিনিয়োগ প্রবিধান করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রবিধানগুলো শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। তবে নতুন কোম্পানিগুলো এই ধরনের ক্রাইম করার সুযোগ নেই। কোনো নতুন বিনিয়োগ করতে হলে আইডিআরএর অনুমতি লাগবে।
আইডিআরের বিনিয়োগ প্রবিধানমালাতে বলা হয়েছে প্রিমিয়ামের ৩০ শতাংশ ট্রেজারি বন্ডে রাখতে হবে, এক ব্যাংকে রাখা যাবে না একাধিক ব্যাংকে রাখতে হবে। এই প্রবিধান করার কারণে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে বিমা খাত। এই প্রবিধান আইডিআরএ যাথাযথ মনিটরিং করা হলে কোনো ধরনের ক্রাইম হবে না।
আমার সংবাদ : বাংলাদেশের বিমা খাতের ভবিষ্যত কী?
এস এম নুরুজ্জামান : বাংলাদেশের বিমা সেক্টরে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের বিমা সেক্টরে বিমা দাবি সমস্যা যদি সরকার সমাধান করে ফেলে বিশেষ করে আইডিআরএ তাহলে বিমা সেক্টরের ৯০ শতাংশ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। ফলে বিমা খাত সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। বিমা কোম্পানির প্রতারণার জন্য আইডিআরএ, অর্থমন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক সাথে কমিটি করে কাজ করলে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
আমার সংবাদ : বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে আপনাদের উদ্যোগ কী?
এস এম নুরুজ্জামান : বিমার প্রধান সংকট হচ্ছে ম্যাচিউরিটির টাকাটা যথাসময়ে না দেয়া। কোম্পানিকে ডিজিটালাইজড করা এবং গ্রাহকের সুবিধা অনুযায়ী বিমা দাবি পরিশোধ ব্যবস্থা অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠানো। গ্রাহক দাবি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় না, পলিসি ম্যাচিউরড় হওয়ার সাথে সাথেই টাকা দিয়ে দিচ্ছি। বিমা খাতে আগ্রহ ফেরানোর জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সভা সেমিনার করছি এবং কর্মীদেরকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে আরও দক্ষ করে তুলছি।
আমার সংবাদ : বিমা খাতের জন্য কোন বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ মনে করেন?
এস এম নুরুজ্জামান : বিমা দাবি যথাসময়ে পরিশোধ না করার কারণে মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়েছে এই নেতিবাচক ধারণাটি আরও বেশি করে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কোম্পানিগুলো ডিজিটালাইজড হতে হবে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে যাতে গ্রাহক নিজেই তার সব কিছু বুঝতে পারে। বিমা দাবি নিয়ে গ্রাহকদের সাথে কথার গরমিল হওয়া। এ বিষয়গুলো সমাধান হলে বিমা খাতের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে পাচ্ছি।