হাজার মানুষের কান্নায়ও গলছে না ওয়াসার কঠিন হৃদয়। তিল তিল করে গড়ে তোলা তাদের স্বপ্নের আবাসনে যেন থাবা বসাতেই হবে। জনপ্রতিনিধিসহ কারো কোনো সুপারিশকেই পাত্তা দিচ্ছে না সংস্থাটি। রাজধানীর রায়েরবাজার পয়োশোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমে ওয়াসার চলমান একগুঁয়েমি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই। আড়ালে থাকা কোনো চক্রের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই ওয়াসার এই একগুঁয়েমি— বলছেন ভূমি মালিকরা। অন্যথায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায়ও কেন থামছে না মেহনতি মানুষের ঘাম বিক্রির টাকায় গড়ে তোলা আবাসন ধ্বংসের প্রক্রিয়া— এমন প্রশ্ন ভূমি মালিকদের। সংশ্লিষ্ট একাধিক জনপ্রতিনিধির ডিও লেটারেরও কোনো মূল্যায়নই করছে না ওয়াসা।
জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, হাজার হাজার গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার উপক্রম হয়েছে সেখানে। এছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় জনবল বিপর্যয়সহ পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষুণ্ন হবে। তবুও কেন বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না হতাশাগ্রস্ত মেহনতি মানুষদের আর্তনাদ আর আহ্বান। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা ছাড়াও স্থানীয়দের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ভূমি মালিকরা বলছেন, হাজারীবাগ থানাধীন উত্তর সোনাটেঙ্গর ও দক্ষিণ সোনাটেঙ্গর মৌজার ৫৪.৯৭ একর জমিতে রায়েরবাজার (কল্যাণপুর) ক্যাচমেন্টে পয়োশোধনাগার নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব করে ঢাকা ওয়াসা। যাতে অনাপত্তি দেয় রাজউক। অথচ প্রস্তাবিত ভূমির উত্তর পাশেই জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও বহুতল ভবন রয়েছে। দক্ষিণ পাশেই রাজউক অনুমোদিত শতাধিক বহুতল আবাসিক ভবন রয়েছে। পূর্ব পাশে বউবাজার, সনাতন গড় ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। দুটি মৌজাতেই অধিকাংশ মালিকের এক কাঠা, দেড় কাঠা, দুই কাঠা, আড়াই কাঠা ও তিন কাঠা করে জমি রয়েছে, যা সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থে ক্রয় করা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীসহ খেটে খাওয়া মানুষদের বেশ কজন মিলে ফ্ল্যাট পাওয়ার বুকভরা আশায় ৫-১০ কাঠার প্লট কিনেছেন। শরিকে প্লট কিনতে কেউ কেউ তাদের গ্রামের বাড়ির স্থাবর সম্পত্তিও বিক্রি করে দিয়েছেন। মৌজা দুটিতেই এখন রাস্তাঘাটসহ অসংখ্য ছোট-বড় স্থাপনা গড়ে উঠেছে। স্যুয়ারেজ লাইনসহ ২৫ ফুট, ২০ ফুট ও ১৬ ফুট প্রশস্ত একাধিক রাস্তা রয়েছে। রয়েছে বিদ্যুৎ লাইন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৫ নং ওয়ার্ডের সিটি কর্পোরেশন কিংবা পূর্বের ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন নিয়েই সুউচ্চ ভবন, পাকা, সেমিপাকা বাড়িঘর, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে এবং সব হোল্ডিং থেকে নিয়মিত হোল্ডিং ট্যাক্সও পাচ্ছে সরকার। এরপরও এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বেড়িবাঁধে অবস্থিত সরকারি বিদ্যালয়, কলেজ, ফায়ার সার্ভিস, কবরস্থান, বধ্যভূমির পরিবেশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ ২০১১-১২ সালে কল্যাণপুর ‘ক’ খালের উত্তর পাশে গৈদারটেক সংলগ্ন ব্যক্তিমালিকানা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিস্তীর্ণ এলাকা (৬১ একর) অধিগ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সেখানে না করে রায়েরবাজারে করার পরিকল্পনাকে বৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলেই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। এর নেপথ্যে শক্তিশালী চক্রের রহস্যময় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। কারণ, ঢাকা-১৪ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের জীবদ্দশায় তিনি নিজেও ডিও লেটার দিয়েছিলেন ওয়াসার এমডিকে— পরিবেশগত কারণ আর জনদুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে প্রকল্পটি যেন ঢাকা-১২-এর উত্তর ও দক্ষিণ সোনাটেঙ্গর মৌজা থেকে সরিয়ে কল্যাণপুরে স্থানান্তর করা হয়। সে সুপারিশেরও কোনো মূল্যায়ন করেননি ওয়াসার এমডি।
ভূমি মালিকরা বলছেন, এখানে কবরস্থান, র্যাব সদর দপ্তরও করার কথা ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস তৎকালে এসব হতে দেননি। এখন সরকার নতুন করে পয়োশোধনাগার করার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৮ সালে রাজউকের কাছে জায়গা চায় ওয়াসা। তখনই এই জায়গাটা চূড়ান্ত করা হয়। যদিও ভূমি মালিকদের মতামত নেয়া হয়নি। রাজউক ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। বাড়ি নির্মাণের সময়ও চুপ ছিল রাজউক। এখন রাজউক অনুমতি দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করছে। এখানে ওয়াসার প্রকল্প হবে— এটাও কেউ জানায়নি। গেলো জাতীয় নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে জায়গাটা নির্বাচন করে ওয়াসা। একনেকেও পাস হয় তড়িঘড়ি করে। চারটি ডিও লেটার দেন তাপসসহ বেশ কজন জনপ্রতিনিধি। কিন্তু কোনো সুপারিশের তোয়াক্কা না করেই ওয়াসা প্রকল্প বাস্তবায়নে একগুঁয়েমি মনোভাব প্রকাশ করছে। এছাড়া উচ্চ আদালতের স্টে অর্ডারকেও উপেক্ষা করছে ওয়াসা। তবে তারা বলছেন মেয়র তাপস আশ্বাস দিয়েছেন এটা এখানে হতে দেবেন না। স্থানীয় কাউন্সিলরসহ অনেকেই এ নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেঁড়ঝাঁপ করছেন। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও এখন এ বিষয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
ভুক্তভোগী মালিকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী মানুষকে ঘর দিচ্ছেন। আর আমাদের বাসযোগ্য ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সেখানকার পঞ্চায়েত সভাপতি হাজী আমজাদ সরদার আমার সংবাদকে বলেন, এখানে ৫০০’র বেশি প্লট রয়েছে। একেকটি প্লটে একাধিক মালিক মিলে ভবন নির্মাণ করছেন। নির্মাণকাজ চলমান। এখানকার সবাই ট্যাক্সধারী, হোল্ডিং নম্বরও আছে। কোনো খাসজমি নেই। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে নীড় গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। কম ভাড়ায় থাকছেন অনেকেই। ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধাচরণ করে একাধিক ভূমি মালিক বলছেন, তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। ১৯৯২ সাল থেকেই বন্যার সময় ওভারলে জোন উঠিয়ে দিয়ে আবাসিক ঘোষণার পরও তাসকিম এ খান এখানেই থাবা দিয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, দুই পাশেই আবাসিক এলাকা রেখে এখানে কেন এই প্রকল্প করতে হবে এবং মাঝখানে মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে।
সরেজমিনে জানা গেছে, ৫০০’র বেশি প্লটে সেখানে চার শতাধিকেরও বেশি পাকা বাড়ি রয়েছে। এক থেকে ১২ তলা পর্যন্ত অন্তত অর্ধশতাধিক পাকা বাড়ির নির্মাণকাজও চলমান রয়েছে। রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানাসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আরও রয়েছে উম্মে হালিমা এতিমখানা ও মাদ্রাসা, এ আর রহমান জামে মসজিদ ও মাদ্রাসাসহ আটটি মাদ্রাসা, পাঁচটি মসজিদ। বর্তমানে পাঁচটি মসজিদেরই নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
জানতে চেয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে গতকাল মঙ্গলবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে ক্ষুদেবার্তা পাঠান এ বলে— ‘এই মুহূর্তে কথা বলা সম্ভব নয়’। ভূমি মালিকরা প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন উল্লেখ করে তার বক্তব্য জানতে চেয়ে পাল্টা ক্ষুদেবার্তা পাঠালে আর সাড়া দেননি তিনি।